রাজধানীর বেইলি রোডের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসেছে সরকারি সংস্থাগুলো। কড়াভাবে চালাচ্ছে রেস্টুরেন্টগুলোতে অভিযান। এসব কারণে বেরিয়ে এসেছে অনুমোদনহীন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের তথ্য। বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টই পরিচালিত হচ্ছে নিয়ম না মেনেই।

স্বাভাবিকভাবেই একটি রেস্টুরেন্ট করতে হলে সরকারি ১২টি সংস্থা বা দপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু অভিযানকালীন দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টই ২-৩ দপ্তর থেকে অনুমোদন নিয়ে বাকি সংস্থার তোয়াক্কা না করেই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।

জানা গেছে, রাজধানীতে একটি রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করতে হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, তিতাস গ্যাস, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে অনুমোদন বা ছাড়পত্র নিয়ে তবেই রেস্টুরেন্ট চালু করা করতে হয়। কিন্তু রাজধানীর বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টই ২-৩ সংস্থা থেকে অনুমোদন বা ছাড়পত্র নিয়েই দিব্যি তাদের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।

যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, একমাত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ছাড়া অন্য যেকোনো স্থানের ছাড়পত্র নেওয়া খুবই কঠিন। রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য নিয়মকানুন এতো কঠিন করা হয়েছে যে, ১২ জায়গা থেকে অনুমোদন নিয়ে এসে ব্যবসা পরিচালনা করা খুবই ভোগান্তির ব্যাপার। দিনের পর দিন এসব সংস্থার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও অনুমোদন পাওয়া যায় না। যে কারণে রেস্টুরেন্ট মালিকরা দুই এক জায়গা থেকে অনুমোদন নিয়েই তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে।

তারকা চিহ্নিত হোটেল ছাড়া দেশে রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরাঁর প্রকৃত সংখ্যা কত, সেই হিসেব কারো কাছেই নেই। তবে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির খসড়া হিসেবে দেশে প্রায় পাঁচ লাখের মতো রেস্তোরাঁ রয়েছে। যার মধ্যে কেবল রাজধানীতেই আছে প্রায় ২৫ হাজার রেস্তোরাঁ। এই সংখ্যার মধ্যে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অনুমোদন নেওয়া আছে ৫ হাজার ৬০০টি রেস্তোরাঁর, সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে প্রায় সাত হাজারের মতো রেস্তোরাঁকে।

তবে অন্যান্য সংস্থা বা দপ্তর থেকে অনুমতি না নিয়েই এসব হোটেল রেস্তোরাঁ মালিকরা রেস্তোরাঁ পরিচালনা করছে। কাগজে-কলমে এসব জায়গা থেকে অনুমোদন নেওয়ার কথা থাকলেও দায়সারাভাবে দুই তিন জায়গা থেকে কোনোমতে অনুমোদন নিয়েই তারা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।

এ বিষয়ে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি রেস্তোরাঁ যখন কোনো মালিক চালু করে তখন তার দুই তিন জায়গা থেকেই অনুমোদন নিতেই খুব কঠিন হয়ে যায়। তারপরেও একজন রেস্তোরাঁ মালিক অনুমোদন ম্যানেজ করে তার রেস্তোরাঁ পরিচালনা করেন। কিন্তু আসল নিয়ম অনুযায়ী ১০ থেকে ১৩টি সংস্থা/দপ্তরের কাছ থেকে রেস্তোরাঁ মালিককে অনুমোদন নিতে হয়। আর সেটা যদি একজন রেস্তোরাঁ মালিক করতে চান তাহলে তার রেস্তোরাই করা হয়ে উঠবে না। কারণ এগুলো ম্যানেজ করা খুব কঠিন। তাই দুই এক জায়গায় অনুমোদন নিয়েই তারা রেস্তোরাঁ পরিচালনা করেন।

একমাত্র এনবিআর থেকে অনুমোদন পাওয়াটা সহজ, কারণ তাদের রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি যুক্ত থাকে। বাকি সব জায়গা থেকে অনুমোদন পেতে হলে একজন মালিককে খুব বেগ পেতে হয়। তবে এটাকে যদি সহজ করা হয় তাহলে সব রেস্তোরাঁ মালিকরাই নিশ্চয়ই সবার অনুমোদন নিয়ে তবেই রেস্তোরাঁ চালু করবে।

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে হলে প্রায় ১০ থেকে ১৩টি সংস্থা-দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সব রেস্তোরাঁয় কিছু না কিছু সনদ থাকে। কারো কাছে কয়েকটি সনদ থাকলে সেই রেস্তোরাঁ অবৈধভাবে ব্যবসা করছে, তা বলার সুযোগ থাকে না। এরপরও যদি কেউ আইনের ব্যত্যয় করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে রেস্তোরাঁ বন্ধ করা, অভিযান পরিচালনা করা কোনো সমাধান নয়। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত তো হবেন, বেকার হবেন আরও অনেকে।

এদিকে রাজউক, সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস বলছে, রেস্তোরাঁ মালিকরা নিয়ম না মানায় অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে। ঘটছে বড় দুর্ঘটনা। এজন্যই অভিযান শুরু হয়েছে। অন্যদিকে রেস্তোরাঁ মালিকদের অভিযোগ, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই অন্যায়ভাবে অভিযান পরিচালনা করছে বিভিন্ন সংস্থাগুলো।

এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনির হোসেন হাওলাদার বলেন, যদিও লোকবল কম, তারপরেও আমরা এখন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। ভবন, রেস্টুরেন্টগুলোর কোথায় কোন ভুল আছে, তা তদরকি করতে আমাদের নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ভবন রেস্টুরেন্টে যেসব অনুমোদনের বিষয়গুলো থাকে, তা অনেকেই মানে না। সে কারণে আমরা সেগুলো এক এক করে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি, যদিও আমাদের লোকবল কম তারপরেও আমরা নিয়মিত তদারকি করে দেখছি, কারা অনুমোদনহীনভাবে ভবন/রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করছে।

রাজধানীতে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, অনুমোদনহীন, নকশাবহির্ভূত ভবন, রেস্টুরেন্টের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, আমরা সব সংস্থার সমন্বয়ে ঢাকার অগ্নিঝুকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। তালিকা পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলোচনা করেছি ইমারত বিধিমালা নিয়ে কাজ করছি।

তিনি আরো বলেন, বহুতল ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে আইন ও বিধিমালার মধ্যে সমন্বয় করা হবে। ভবন অনুমোদন, নকশা ঠিক আছে কী না, রেস্টুরেন্টকে ঠিকমতো সব নিয়ম মেনে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কী না, এগুলো আমরা দেখছি। সেখানে যদি রাজউকের কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীর দায় পাওয়া যায়, তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

এএসএস/পিএইচ