গরম এলেই রাজধানীতে পানি সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেয়। সাধারণত এপ্রিল ও মে মাসে রাজধানীতে পানির সংকট দেখা দিলেও এবার মার্চ মাসের মাঝামাঝিতেই বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। চলছে রমজান মাস। যেহেতু রমজান মাসে পানির চাহিদা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকে, এই অবস্থায় এসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট দেখা দেওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা।

রাজধানীর মিরপুর, শেওড়াপাড়া, বাড্ডা, নতুন বাজার, রামপুরা, মেরুল, ডিআইটি, মালিবাগ, বাসাবো, মুগদা, মান্ডা, লালবাগ, রায়েরবাগ, পুরান ঢাকা ও দক্ষিণখান এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গত ৩-৪ দিন ধরে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। রমজান মাসে এমন পানির সংকটে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা।

পানির চাহিদা মেটাতে এসব এলাকার বাসিন্দারা বারবার ওয়াসার গাড়ির মাধ্যমে পানি নেওয়ার জন্য ফোন করলেও সময়মতো পানি পাচ্ছেন না। ঢাকা ওয়াসার আওতায় ১০টি মডস জোনে পানির চাহিদা জানানো হলে বিশেষ গাড়ির মাধ্যমে বাসা বাড়িতে পানি পৌঁছে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে প্রতি ছয় হাজার লিটারের একটি বড় গাড়িভর্তি পানির জন্য নেওয়া হয় ৬০০ টাকা। কিন্তু চাহিদা অনেক বেশি থাকায় ফোন করেও এসব পানির গাড়ি পাচ্ছেন না পানি সংকটে থাকা এলাকার বাসিন্দারা। ৬০০ টাকার জায়গায় ১০০০ টাকা দিয়েও সিরিয়াল পাচ্ছেন না তারা। আর পানির সংকটের কারণে চাহিদা বেশি থাকায় গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি টাকা দাবি করছেন গাড়ির দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা।

হঠাৎ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকটের কারণ হিসেবে ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সার্বিকভাবে পানি সরবরাহে ঘাটতি নেই। তবে গরম সৃষ্টি হওয়া এবং রমজানের কারণে পানির চাহিদা বেড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় গভীর নল কূপের মাধ্যমে পানির উত্তোলন কিছু কিছু জায়গায় কম হচ্ছে, মূলত সেসব এলাকাতেই কিছুটা পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া, কিছু এলাকায় ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপ কম থাকায় সেসব এলাকাবাসীকে কিছুটা পানির সংকট পোহাতে হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসা এ বিষয়ে কাজ করছে, আশা করা যায় অল্প সময়ের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ হীরা বলেন, গত চার দিন ধরে আমার বাসাসহ আশেপাশের এলাকায় পানি সরবরাহ নেই। আমরা যারা বাসার মালিক আছি তারা ওয়াসার মডস জোনে যোগাযোগ করে পানি আনার ব্যবস্থা করছি। ৬০০ টাকার পানি অনেক সময় এক হাজার টাকা লেগে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও চাহিদা মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। রমজান মাসে পানির যে চাহিদা থাকে, সেটি সবাই জানে। পানি ছাড়া একটা দিন অতিক্রম করা খুব কঠিন। আমরা পানি ছাড়া খুব কষ্টে আছি। বারবার ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে, কিন্তু ৪ দিন হলো এখনো পানি সরবরাহ ঠিক হয়নি। 

মান্ডা এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামও একই ধরনের অভিযোগ জানিয়ে বলেন, যেহেতু রমজান মাস, সেহেতু ইফতার ও সেহরিসহ দিনব্যাপী বাসায় প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের কী দুর্ভাগ্য! রমজান মাসেও আমরা ঠিকমত পানি পাচ্ছি না। গভীর রাতে একবার করে পানির গাড়ি আসে, সেই পানি কিনে নিয়ে ট্যাংকিতে রাখি। ভাড়াটিয়াদের সারাদিনে একবার পানি দিতে পারি কোনোমতে। ভাড়াটিয়াসহ আমরা সবাই পানি না থাকায় এই রমজানে খুব সমস্যার মধ্যে রয়েছি।

শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা রেবেকা সুলতানা পানির সমস্যা নিয়ে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, রমজান মাসে পানি ছাড়া কোনোভাবেই চলা যায় না। সে জায়গায় এক বালতি পানি দিয়ে থালাবাসন ধুতে হচ্ছে, সেটি দিয়েই আবার ভাত বসাতে হচ্ছে। গোসল তো ৩ দিন করাই হয়নি। পানি ছাড়া একদম অসহায়ের মত অবস্থা পুরো এলাকাবাসীর। পাত্র যেন ধুতে না হয়, তাই অনেক সময় বাইরে থেকে খাবার কিনে নিয়ে এসে আমাদের খেতে হচ্ছে এই রমজান মাসে। বছরের অন্যান্য সময় পানির সংকট থাকে, কিন্তু রমজান মাসে পানি না থাকলে কেমন ভয়ঙ্কর অবস্থা হতে পারে তা আমরা এখন বুঝতে পারছি। আশপাশের বাসার মালিকরা মিলে বারবার ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তারপরও পানির সমস্যা সমাধান হচ্ছে না।

পানির সংকটের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, সার্বিকভাবে ঢাকা শহরে পানির সংকট নেই। রাজধানীর কিছু কিছু এলাকায় সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, আমরা সেসবের কাজ করছি, আশা করা যায় খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, সার্বিকভাবে পানি সরবরাহে ঘাটতি নেই। তবে গরম ও রমজানের কারণে ঢাকায় পানির চাহিদা বেড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপে মাধ্যমে পানির উৎপাদন কিছু কিছু জায়গায় কম হচ্ছে, মূলত সেসব এলাকাতেই কিছুটা পানির সংকট দেখা দিয়েছে। রাজধানীর যেসব স্থানে পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে আমরা সেখানে রেশনিং পদ্ধতিতে পানি সরবরাহের কাজ করছি।

এদিকে, ঢাকা ওয়াসার দাবি, চাহিদার তুলনায় বেশি পানি উত্তোলনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের। অন্যান্য সময় বা শীতকালে রাজধানীতে দৈনিক পানির চাহিদা থাকে ২১০ কোটি লিটার থেকে কখন কখনও ২৩০/২৪০ কোটি লিটার। কিন্তু গরমকাল এলে এটা বেড়ে ২৬০ কোটি লিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার প্রতিদিন প্রায় ২৯০ কোটি লিটার পানির উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন এখন গড়ে ২৬০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে ঢাকা ওয়াসা। সার্বিকভাবে পানি সরবরাহের কোনো সমস্যা নেই, তবে কিছু কিছু এলাকায় পানি সরবরাহের সাময়িক সমস্যা হচ্ছে।

বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি শোধনাগার রয়েছে পাঁচটি। তবে, সংস্থাটি পানি পাচ্ছে চারটি শোধনাগার থেকে। উপরিতলের পানির উৎপাদন ৭০ শতাংশে উন্নীত করার কথা থাকলেও সেই লক্ষ্য এখনও পূরণ করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। বর্তমানে উপরিতলের পানি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। আর বাকি ৬৫ শতাংশ ওয়াসার সরবরাহ করা পানি তারা পাচ্ছে ভূগর্ভস্থ থেকে।

এএসএস/কেএ