রাজধানীর বনানীর গোডাউন বস্তিতে ঢোকার মুখে কর্দমাক্ত রাস্তা মাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে দেখা যায় এক ব্যক্তিকে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কানে ভেসে আসে তার কোলে থাকা একটি শিশুর করুণ আবেদন- ‘বাবা বিছনা পাতি দেও, ঘুমামু!’ 

ঘুমাতে চাওয়া শিশুর নাম তাসলিমা। তার বাবা অব্দুর রউফ এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিলেন মেয়েকে বসানোর বা শোয়ানোর জায়গা। কিন্তু এতটুকু জায়গা আর মিলছে না। সর্বত্র পোড়া জঞ্জালে ভরে আছে গোডাউন বস্তি।

পেশায় কসমেটিকসের ফেরিওয়ালা আব্দুর রউফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগুনের সময় ঘরেই ছিলাম। তাসলিমা ছিল আমার সঙ্গে। পরিবারের বাকিরা বাইরে ছিল। হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকার...  তাসলিমাকে কোনো রকমে কোলে নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হই। ততক্ষণে আগুন চলে আসে পাশের ঘরে। 

রউফ বলেন, আগুনের লেলিহান শিখা আর পুড়তে থাকা ঘর দেখে তাসলিমা রাতে ঘুমাতে পারেনি। নির্ঘুম রাত কাটানো মেয়েটা এখন ক্লান্ত, খুঁজছে বিছানা, শুয়ে একটু ঘুমাতে চায়। ওরে কেমনে বুঝাই আগুনে আমার সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, ঘুমানোর জায়গা আর নাই.. ।

রোববার (২৪ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে আগুন লাগে বনানীর গোডাউন বস্তিতে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।  

শামসুন্নাহার-কবির হোসেন দম্পতির দুঃখটা যেন আরও বেশি। দুমাস আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ঈদের পরেই মেয়েকে জামাইয়ের ঘরে তুলে দেওয়ার কথা ছিল।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুনে গোডাউন বস্তির দুই শতাধিক বাসিন্দা হারিয়েছেন ঘর। অধিকাংশ মানুষ ঘর থেকে বেরিয়েছেন এক কাপড়ে। আগুনে সবকিছু পুড়ে যাওয়ায় ধ্বংসস্তূপের উপর খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করতে হয় তাদের। কেউ কেউ পাশের একটি স্কুলে আশ্রয় নেন।

গোডাউন বস্তির বাসিন্দা মিলি আক্তার। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। ১২ বছর ধরে এই বস্তিতে বসবাস করা মিলির স্বামী রফিকুল ইসলাম রিকশা চালক। 

বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ করা মিলি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কাজে ছিলাম, স্বামী খ্যাপ নিয়া গেছিল বসুন্ধরায়। খবর পায়া ছুটে আইসা দেখি ঘরের দোরে (সামনে) আগুন। নিজের পরনের কাপড় ছাড়া কাঁথা কম্বল, হাড়ি পাতিল, টিভি ফ্রিজ কিছুই বের করতে পারি নাই। গত রাতেও এক লগে সবাই ঘুমাইছি। আর এই রাত কাটল খোলা আকাশের নিচে। নিঃস্ব হয়া (হয়ে) গেছি ভাই, সব শেষ।

আগুনে নিঃস্ব হওয়া বস্তির আরেক বাসিন্দা রেহানা আক্তার বলেন, গোসল করতে গেছি। আসার সময় শুনি আগুন। ওই যে দেখতাছেন, দোতলা ঘর ওইহান থেকে আগুনটা লাগছে। কেমনে লাগছে জানি না, বাতাসে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভেজা কাপড়ে ঘরে ফিইরা দেহি স্বামী মফিজ উদ্দিন ঘুমাইতাছে। তারে ঘুম থেকে তুইলা রাস্তার ধারে যাই।

রেহানা আক্তার বলেন, কী করতাম, কই যাইতাম, কিছু করবার তো পারি নাই। সব তো পুইড়া শেষ, এখন কী খামু, কই যামু! সাজানো ঘর অঙ্গার, এক আগুনে ছাদটা শূন্য হয়ে গেলো। পিন্দনের (পরনের) কাপড়টা ছাড়া কিচ্ছুই আর অবশিষ্ট নাই। বাচ্চাগুলার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না, বই খাতাও পুড়ে গেছে, বের করতে পারিনি। 

রেহানার স্বামী মফিজ উদ্দিন সিটি করপোরেশনে ময়লার কাজ করেন। তিনি বলেন, পা ভাঙছে তিনবার। কাজ আর আগের মতো করতে পারি না। তিনডা বাচ্চা নিয়া এখন কী করমু। 

শামসুন্নাহার-কবির হোসেন দম্পতির দুঃখটা যেন আরও বেশি। দুমাস আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ঈদের পরেই মেয়েকে জামাইয়ের ঘরে তুলে দেওয়ার কথা ছিল।

কবির হোসেন বলেন, দুই ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে, ওখানেই থাকে। মেয়েকে বিয়ে দিছি। মেয়ের বিয়ের বিদায় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিছি। আগুনে সব শেষ। বাচ্চাডার বিয়ের কাপড়, মেয়ের জন্য বানানো একটা চেইন, কানের জিনিস, বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য জমানো ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ছিল। কিচ্ছু নিতে পারি নাই। 

শামসুন্নাহার বলেন, এখন কী করমু, পথে বসার দশা। মেয়েডার সংসারটা কেমনে কী করব! জামাইয়ের ঘরে ওরে কেমনে উড়ামু!

গোডাউন বস্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছির ঢাকা পোস্টকে বলেন, গোডাউন বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের দুঃখ কষ্টের কথা বিবেচনা করে আমরা টিএনটি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে তাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করেছি  খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করছি। এখন পর্যন্ত হিসাব করে জানতে পেরেছি সেখানে ২২০ থেকে ২২৫টি ঘর পুড়েছে। সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের জন্য ক্ষতিপূরণ বা আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

জেইউ/এমএসএ