ডিজেলের দাম কমানোর সঙ্গে সঙ্গে ডিজেলচালিত যানবাহনের ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের ভাড়া নির্ধারণ কমিটি। কত টাকা কমানো হবে তা ঠিক করতে সোমবার (১ এপ্রিল) দুপুরে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কার্যালয়ে সমন্বয় সভায় বসেন বাস মালিকরা।

নানা যুক্তিতর্কের পর ভাড়া ৩ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত এসেছে। তবে ঈদের আগে ভাড়া না কমানোর দাবি জানিয়েছেন মালিকরা। তারা বলছেন, ঈদের আগে ভাড়া কমালে সেটা নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। সরকারি অফিস বন্ধ থাকায় তারা তদারকি করতে পারবে না, মালিকরাও ঠিকমতো তদারকি করতে পারবেন না।

২০২১ সালের নভেম্বরে ও পরের বছরের আগস্টে দুই দফায় ডিজেলের দাম লিটারে ৪৯ টাকা বৃদ্ধি পায়। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরীণ রুটের বাসের ভাড়া কিলোমিটারে দুই দফায় ৮০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়েছিল। দূরপাল্লার বাসের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছিল কিলোমিটারে ৭৮ পয়সা।

২০২২ সালের আগস্টে ডিজেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমলে কিলোমিটারে বাসের ভাড়া কমে ৫ পয়সা। ওই বছরের ৩১ আগস্ট নির্ধারণ করা ভাড়ায় এখনো চলছে বাস। শহরের অভ্যন্তরে বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৪৫ পয়সা। আর দূরপাল্লার বাসের ভাড়া কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সা। সবমিলিয়ে ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কিলোমিটারে ৮০ পয়সা ভাড়া বাড়লেও কমেছে মাত্র ৮ পয়সা।

রোববার (৩১ মার্চ) ডিজেলের দাম ২ টাকা ১৫ পয়সা কমানো হয়। এরপর আজ দুপুরে বিআরটিএর সদর দপ্তরে বসে সরকারের ভাড়া নির্ধারণ কমিটি। সেখানে ভাড়া কমানোর বিষয়ে কথা উঠলে তেলের দামের বাইরে পরিবহন সেক্টরের নানা পণ্য ও কারিগরি শ্রমের মূল্য বেড়ে যাওয়ার বিষয় তুলে ধরেন মালিক সমিতির নেতারা।

সভায় বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, যখন ৭৫ পয়সা তেলের দাম কমেছিল তখন কিন্তু ভাড়া কমানোর জন্য মিটিং ডাকিনি। তখন কিন্তু সাংবাদিকরা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। আমি বলেছি এই ৭৫ পয়সা কমনোর বিপরীতে ভাড়া সর্বোচ্চ এক পয়সা কমাতে পারব। এই কমানোয় কার কী উপকার হবে? বহির্বিশ্ব যেভাবে ভাড়া কমানোর জন্য কাজ করে আমরাও সেভাবে কাজ করার জন্য মিটিংগুলো ডাকি। কিন্তু অটোমেটিক্যালি এগুলো কীভাবে করা যায়, সেটা করার সময় আমাদের এসেছে। আমাদের ম্যাগনেটিকালি এগোতে হবে।

এসময় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, পাশের দেশ ভারত, সেখানে কী হারে বাড়ানো-কমানো হয় সেটা আমরা দেখতে পারি। সরকার প্রতি মাসে ভাড়া কমানো-বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা দুই-এক মাস এটা দেখতে পারি, কীভাবে এটা করা হয়। কীভাবে মিটিং ছাড়া এটি বাড়ানো-কমানো যায়।

তখন বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ভারতে অল্প অ্যামাউন্ট হলে কিন্তু সেটা করা হয় না। আমি এটা খোঁজ নিয়েছি। আমরা তাদের ফর্মুলাটাও ফলো করতে পারি কি না দেখছি।

এসময় সময় বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে বলেন, আপনার সামনে লিস্ট আছে ভাড়া বৃদ্ধি ও কমানোর। অনেকগুলো প্যারামিটার রয়েছে। যদি প্যারামিটারগুলো অ্যানালাইসিস করে কাজ করেন, তাতে কোনো আপত্তি থাকবে না। টায়ারের দাম কিন্তু ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে মাত্র টায়ার কিনে নিয়ে এলাম।

এরপর বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, যশোর অটো থেকে আমরা সার্ভে করে এসেছি। ১০/২০ সাইজের টায়ার ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা, এমআরএফ টায়ার ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, অ্যাপোলো টায়ার ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং জে কে টায়ার ইন্দোনেশিয়া ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা।

মশিউর রহমান রাঙ্গা আবার বলেন, আমাদের দেশে যদি তেলের দাম বেড়ে যায় তাহলে ভাড়া অটোমেটিকলি বেড়ে যাবে এবং তেলের দাম যদি কমে যায় তাহলে কমবে। ইন্টারন্যাশনালি কিন্তু রেগুলার দাম বাড়ছে-কমছে। সরকার একটা সিস্টেমে আসতে চায়, যেখানে তেলের দাম বাড়লে অটোমেটিক বাসের ভাড়া বাড়বে এবং তেলের দাম কমলে বাসের ভাড়া কমবে। কারণ আমরা পরিবহন মালিকরাই সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল কনজিউম করি।

তিনি বলেন, এর সঙ্গে পরিবহনের যে আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলো আছে, যেমন চাঁদা বেড়েছে। আমরা কি এর জন্য বলতে পারি, চাঁদা বেড়েছে বলে ভাড়া বাড়বে? ব্যাটারির দাম বেড়েছে এজন্য আমরা ভাড়া বাড়াতে পারি। গাড়ির যন্ত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে তেলের বিষয়টা আলাদা। এটাই উনারা (বিআরটিএ) বোঝাতে চেয়েছেন। এটা মানবিক কারণে তারা বলতে চাইছেন, তেলের দাম কমলে আমাদের আর কয় পয়সা কমবে। কিন্তু এর সঙ্গে অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেল, সেখানে তো আমাদের একটা সমস্যা থেকেই গেল। বাস মালিকদের আপত্তিটা এ জায়গাতেই।

এবার বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, বিদ্যমান ভাড়ার সঙ্গে মার্চ মাসে যে ভাড়া বাড়ল ও তেলের দাম কমল– এই সবকিছু মূল্যায়নে এনে দূরপাল্লার বাসে ২ টাকা ১৫ পয়সার জায়গায় আড়াই পয়সা কমেছে। এতে করে ২ টাকা সাড়ে ১২ পয়সা হয়েছে। এটাকে আমরা রাউন্ড করে ফেলব। এখানে তিন পয়সা কমাতে হবে। এখানে ২ টাকা ১৫ পয়সার জায়গায় আমরা ২ টাকা ১২ পয়সা প্রস্তাব করছি। মহানগর এলাকায় ২ টাকা ৪৫ পয়সার জায়গায় ২ টাকা ৪২ পয়সা প্রস্তাব করছি।

মশিউর রহমান রাঙ্গা তখন বলেন, আমাদের জন্য এখন পরিবহন চালানো কষ্টকর হয়ে গেছে। তেলের দাম অনেক কম ছিল। হঠাৎ করে ১৮ টাকা বেড়ে গেছে। তখন কিন্তু আমরা আন্দোলন করিনি। আমরা বিআরটিএর অপেক্ষায় ছিলাম ওনারা কী বলেন। আমরা কিন্তু তখন মেনে নিয়েছিলাম। অনেকদিন পরে কিন্তু আপনারা বসেছেন। তখন কিন্তু আনুপাতিক হারে ভাড়া বৃদ্ধিটা হয়নি। সবকিছু অ্যাসেসমেন্ট করে একটা সিস্টেমে গেলে তখন বিষয়টা ভালো হবে। তেলের দাম কমানোর সঙ্গে সঙ্গে যখনই ভাড়া কমানোর বিষয়টি আসবে, তখন কিন্তু দেশের মানুষকে খুশি করা হবে। এতে করে আমরা যারা পরিবহন মালিক আছি, তারা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমরা বিআরটিএকে সহযোগিতা করি, বিআরটিএ আমাদের সহযোগিতা করবে, এটাই বাস্তবতা। তাই আমাদের অনুরোধ থাকবে, পরিবহনের অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম বাড়লে-কমলে ভাড়া কীভাবে কমানো-বাড়ানো যায় সে দিকটা দেখা হোক।

তিনি আরও বলেন, ঈদের আগে এটা নিয়ে আমরা আর বসতে চাই না। আমাদের মনে হয় আপনাদেরও ব্যস্ততা বাড়বে। আমরা এখন ঈদে যেন কোথাও যানজট না হয়, সব যাত্রী যেন ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারে সেই বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যে এমন একটা উটকো ঝামেলা! বেড়ে গেলেও ইমপ্লিমেন্ট করা অসম্ভব, কমে গেলেও ইমপ্লিমেন্ট করা অসম্ভব। আমরা অ্যাডভান্স টিকিট বিক্রি করে দিয়েছি। রেলও বিক্রি করে দিয়েছে, প্লেনও বিক্রি করে দিয়েছে। সেই কারণে আমার মনে হয় ঈদের পরে এটা নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে বসা যেতে পারে। যদি এখনই হুট করে বাড়িয়ে দেন বা কমিয়ে দেন তাহলে এটা দেখার কেউ থাকবে না।

এমন সময় রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ইন্ডিয়া লুব্রিক্যান্ট আমদানি করে না, টায়ার আমদানি করে না, ব্রেক-সু আমদানি করে না। ওদের ভাড়া কমাটা কিন্তু কনস্ট্যান্ট করে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, আমার মহাসচিব (খন্দকার এনায়েত উল্যাহ) এক মাস যাবত অসুস্থ, তিনি দেশের বাইরে আছেন। তিনি না থাকলে বাস ভাড়া কমানো-বাড়ানো আমাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়ে। মহাসচিব ঈদের আগে দেশে চলে আসবেন। আমার প্রস্তাব থাকবে, আপনারা এই কাজটা ঈদের পরে করেন। ঈদের আগে যদি ডিক্লারেশন দেন এবং প্রজ্ঞাপন জারি হয়ে যায় তাহলে রাস্তাঘাটে মারামারি হয়ে যাবে। ঈদের আছে আর মাত্র আট দিন।

তখন বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। আমার পারসোনাল কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে আমি যেতে পারব না। সরকার তো তাহলে ঈদের পরও তেলের মূল্য কমাতে পারত। সরকার যেভাবে চালাবে আমরা সেভাবেই চলব।

বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, তেলের দাম বাড়া শুরু হয়েছে ২০১১ সাল থেকে। একবার ৩৪ টাকা তেলের দাম বৃদ্ধির পর আমরা যে ১ টাকা ৪২ পয়সা এবং ১ টাকা ৩২ পয়সা প্রস্তাব করেছিলাম সেটা কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক ধাক্কাধাক্কির পর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। তখনো কিন্তু কম ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে তিনি বলেন, আপনি মালিকদের প্রস্তাবনা পাঠান। সঙ্গে তাদের মতামতটাও পাঠান। এটা যেন ঈদের পরে করা হয়, আরও আলোচনা করে। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, সেখানে আপনি আধা পয়সা কমিয়েছেন। লুব্রিক্যান্টের দাম, টায়ারের দাম ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের দাম ধরে ঠিক করুন।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের দাবি ৫ পয়সা কমানো হোক। ৩ পয়সা তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।

সরকারের ভাড়া নির্ধারণ কমিটি যে সুপারিশ করল

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচল করা ডিজেলচালিত ৫২ আসন বিশিষ্ট বাসের প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ব্যয় বিশ্লেষণ মোতাবেক ২ টাকা ৪৫ পয়সার জায়গায় ২ টাকা ৪২ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। ওই এলাকায় চলাচল করা মিনিবাসের সর্বোচ্চ ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৩২ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচল করা বাস ও মিনিবাসের বর্তমান ভাড়া হবে যথাক্রমে ২ টাকা ৪২ পয়সা ও ২ টাকা ৩২ পয়সা। সর্বনিম্ন ভাড়া যথাক্রমে ১০ টাকা ও ৮ টাকা।

এ ছাড়া আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচল করা ডিজেলচালিত ৫২ আসন বিশিষ্ট বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সার জায়গায় ২ টাকা ১২ পয়সা সুপারিশ করা হয়।

এমএইচএন/এসএসএইচ