যানজট, জলাবদ্ধতা, গ্যাস ও পানির অভাবসহ নানা সংকটে জর্জরিত ঢাকা শহর। এসব সমস্যা ও সংকট ছাপিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় থাকে মশার উপদ্রব। ক্ষুদ্র এ কীটের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসীকে বাঁচাতে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। কেবল বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছা যায়।

অভিজাত এলাকা থেকে নিয়ে বস্তি এলাকা; রাজধানীর এমন কোনো স্থান পাওয়া যাবে না যেখানে মশার উপদ্রব নেই। কিছুদিন আগে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার উপদ্রব থাকলেও বর্তমানে বেড়েছে কিউলেক্স মশা। মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগকে ‘লোক দেখানো’ বলে সমালোচনা করছেন নাগরিকেরা। এমন সমস্যা থেকে বাদ যায়নি আফতাবনগর এলাকার বাসিন্দারাও। হঠাৎ মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন সেই এলাকার বাসিন্দারা।

আফতাবনগরের ব্লক বি এলাকার প্রধান সড়কে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন সিএনজি চালক মোরশেদ আলী। ‌মশার উপদ্রবে তিনি যাত্রী ছাড়াই সিএনজি স্টার্ট দিয়ে যাত্রী না নিয়েই সামনের দিকে চলে গেছেন। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় মোরশেদ আলীর সঙ্গে।

তিনি বলেন, যাত্রী পাওয়ার লক্ষ্যেই সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম। ‌কিন্তু দশ মিনিটও দাঁড়াতে পারি নাই। কারণ এত মশা আমাকে ঘিরে ধরেছে, যে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। হাত-পাসহ শরীরের এমন কোনো অংশ নেই যেখানে মশা ধরেনি। তাই বাধ্য হয়ে সে জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। তবুও ছাড়ছে না মশা, বলতে গেলে পুরো আফতাবনগর জুড়েই মশার উপদ্রব।

বুধবার (৩ এপ্রিল) রাজধানীর আফতাবনগরে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এ ব্লক থেকে এন ব্লক পর্যন্ত বিশাল এলাকা নিয়ে আফতাবনগর গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন স্থানে গৃহস্থালি বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এছাড়া ভেতরের বিভিন্ন ভাঙা সড়কে কোথাও কোথাও পানি জমে আছে। এলাকা সংলগ্ন একটি খাল বয়ে গেলেও সেটার পানি প্রবাহ নেই। খালের পাশজুড়ে ময়লা-আবর্জনা। যা মশা প্রজননের উৎকৃষ্ট স্থান।

এলাকাবাসী বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের মশার ওষুধ ছেটানোর কথা থাকলেও তারা নিয়মিত আসে না। আর আগেও মশার উপদ্রব ছিল, তবে কিছু দিন ধরে মশার উৎপাত অনেক বেড়েছে।

আফতাবনগর ব্লক সি এর প্রথম রোডের ৫ তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বাস করেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, কিছুদিন ধরেই হঠাৎ করে মশার উপদ্রব তীব্র হয়েছে। দিন নেই, রাত নেই সবসময় শুধু মশা ঝেঁকে ধরছে। এত যে মশা বেড়েছে, কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের মশা মারার কোনো লোকের দেখা পাই না। আমরা যে সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকার বাসিন্দা, তা ভাবে না সিটি কর্পোরেশন। অথচ হোল্ডিং ট্যাক্সের সময় কোনো ছাড় নেই। কিন্তু যখন মশা আমাদের চেপে ধরছে তখন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখছি না সিটি কর্পোরেশনকে।

একই এলাকার একজন বাড়ির মালিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আফতাবনগরের সাইট দিয়ে একটি খাল চলে গেছে, খালে কোন স্রোত নেই। এখানে-ওখানে পানি জমা, মানুষও গৃহস্থালি বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলে রাখে, প্লাস্টিকের বোতলসহ অন্যান্য পাত্র ফেলে রাখে। গত কয়েকদিন আগে বৃষ্টি হয়েছে, এসব বৃষ্টির পানি পাত্রে ময়লা-আবর্জনায় জমেছিল। সেখান থেকেই মূলত মশা জন্মেছে, তাই কিছুদিন যাবত মশার উপদ্রব অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া বাসার ভাড়াটিয়াসহ অন্যান্যরা রাস্তার পাশে বর্জ্য ফেলে রাখে। সিটি কর্পোরেশনের গাড়িও নিয়মিত বর্জ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যায় না। যে কারণে সেসব জায়গায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। এসব কারণে অবশ্যই সিটি কর্পোরেশনকে দোষারোপ করতে হবে, কারণ তারা নিয়মিত এই এলাকায় এসে মশার ওষুধ ছিটায় না। খুব কম সময় কর্মীদের আমাদের এলাকায় দেখা যায়।

আফতাবনগর ব্লক এ এলাকার ৩৭ নম্বর প্লটের প্রজেক্ট ম্যানেজার তাজুল ইসলাম বলেন, ইদানীং মশা এতটাই বেড়েছে যে এক জায়গায় দশ মিনিট সময়ও বসে থাকা যায় না। কারণ মশা এসে ঘিরে ধরে। কয়েলও মানে না এখনকার মশা। দিনের বেলাও মশার উপদ্রব যেমন, রাতের বেলা ঘুমানোর সময় আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে কিছুদিন ধরে মশার উপদ্রব তীব্র হয়েছে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে আফতাবনগরের বাসিন্দা গৃহিণী শারমিন আক্তার বলেন, আমরা চার তলায় থাকি তারপরও মশার অত্যাচারের কোনো কমতি নেই। দিনরাত সবসময় মশা কামড়ে যাচ্ছে আমাদের। বাসায় ছোট বাচ্চা আছে, সেই কারণে কয়েল জ্বালাতে পারি না। দিনেও মশারি টানিয়ে রাখতে হচ্ছে, রাতেও মশারি টানাতে হয়। সবমিলিয়ে ইদানীং মশার অত্যাচার প্রকট আকার ধারণ করেছে।

রাজধানীর আফতাবনগর এলাকা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। উত্তর সিটির ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে মশার সঙ্গে যুদ্ধে মোট ১১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখেছে। কিন্তু এই বিপুল অর্থ খরচ করেও মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না উত্তর সিটি।

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ের মশক নিধন সুপারভাইজার মাসুদ রানা বলেন, আমাদের মশক নিধন টিম নিয়মিত মশার ওষুধ ছেটানোসহ সার্বিক কাজ করে যাচ্ছে। তবে আফতাবনগরসহ আশপাশের কিছু এলাকায় হঠাৎ মশা বেড়েছে; এমন অভিযোগ আমরাও পেয়েছি, আপনিও জানালেন। আগামীকাল থেকে এ বিষয়ে কার্যক্রম আরও বাড়াবো। মশক নিধন কর্মীরা নিয়মিত সেখানে মশার ওষুধ স্প্রে করবে। 

যদিও মশা নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে অভিযান পরিচালনা করেছে তারা। প্রতিটি বাসাবাড়িতে অত্যাধুনিক ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎস খুঁজতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হয়। যেসব বাড়িতে মশার লার্ভা পাওয়া যায় তার একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয় এবং বছরের অন্যান্য সময় মশক নিধন কার্যক্রমে এটি কাজে লাগায়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, এডিস মশার উৎস খুঁজতে ড্রোনের মাধ্যমে এক লাখ ২৮ হাজার বাড়ির ছাদ পরিদর্শন করা হয়েছে। ড্রোনের মাধ্যমে ছাদ বাগানগুলো মনিটরিং করা হয়েছে। ফলে একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সময় এমন নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেও রাজধানীবাসীকে মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে পারছে না সংস্থাটি।

এএসএস/এমজে