রাজধানী ঢাকায় যাকাত ফিতরাসহ দানের টাকা বেশি পাওয়া যায়— এই আশায় বিপুল সংখ্যক ভিক্ষুক রমজান ও ঈদ উপলক্ষ্যে রাজধানীতে এসেছেন। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক, অলিগলি, ফুটপাথ, ট্র্যাফিক সিগন্যাল, বিপণিবিতান, বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন ও মসজিদের সামনে মৌসুমি ভিক্ষুকরা ভিড় করছেন প্রতিদিন।

মৌসুমি ভিক্ষুকদের মধ্যে অনেক বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ রয়েছেন। তাদের সুরক্ষা দিতে এবং রাজধানীতে ভিক্ষাবৃত্তি কমাতে অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে অসুস্থ ও বয়স্ক ভিক্ষুকদের ধরে ধরে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। গত ২ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৬৭ জন ভিক্ষুককে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন অভিযান পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটরা। 

অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ভিক্ষুকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরপরও প্রতিদিনই বাড়ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। এদের বড় অংশই কেবল ঈদ উপলক্ষ্যে ভিক্ষা করতে এসেছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মৌসুমি ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট। তাদের বেশিরভাগ এসেছেন ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোণা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও মানিকগঞ্জ থেকে। রমজান মাসের শুরু থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত তারা রাজধানীতে অবস্থান করবেন। এরপর নিজ এলাকায় ফিরে যাবেন। এদের সবার ভিক্ষা করা মূল পেশা নয়। শুধু রমজান মাসে ঢাকা শহরে এসে ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত হন তারা। আর কিছু মানুষ আছেন যারা জেলা শহরে ভিক্ষা করেন। এখন ঢাকায় এসেছেন। উদ্দেশ্য একটাই-- কিছু টাকা আয় করে ঈদে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। অনেকে আবার এই আয় দিয়ে কয়েক মাস চলার বন্দোবস্ত করতে চান।

একাধিক ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমি এসব ভিক্ষুকদের মূল টার্গেট থাকে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে ভিক্ষা করা। এর মধ্যে গুলশান, বনানী, নিকেতন, বারিধারা এলাকায় ঢুকে ভিক্ষা করতে পারলে প্রচুর অর্থ পাওয়া যায়। যে কারণে সবার টার্গেট থাকে এসব এলাকায় গিয়ে ভিক্ষা করা। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অভিযানে তারা আতঙ্কিত হয়ে আছেন। ‌এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন দেখছেন কেউ নেই তখনই কেবল সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ির সামনে গিয়ে ভিক্ষা চান তারা।

রাজধানীর গুলশান ২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কে কথা হয় মৌসুমি ভিক্ষুক নাসির‌ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাড়ি ময়মনসিংহ, সেখানেই আমি ভিক্ষা করতাম। কিন্তু এই রমজান মাসে আমার এলাকার আরও পাঁচজন ভিক্ষুকের সঙ্গে রাজধানীতে এসেছি। এই সময় এখানে ভিক্ষা, যাকাত ফিতরার অনেক বেশি টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু এবার এসে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে না কারণ ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেশি। আর গুলশান বনানী বা এসব এলাকায় ভিক্ষা করতে ঢোকা যায় না, নতুন কাউকে তারা ঢুকতে দেয় না। কিন্তু আমার পরিচিত একজন আছে বলে আমি এখানে ঢুকে এই এলাকায় ভিক্ষা করছি। দু’একদিন বেশি টাকা পাওয়া যায় কিন্তু এখন ভিক্ষুকের সংখ্যা বেশি, সিগন্যালে গাড়ি পড়লেই সবাই ছুটে যায়, সে কারণে টাকার পরিমাণ একটু কমে গেছে। তবে এই ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল এখানে। দুই দিন ধরে সিটি কর্পোরেশনের লোক এসে ভিক্ষুকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তাই কিছু কমে গেছে। আমরাও ভয়ে আছি ধরা খাওয়ার।

টাঙ্গাইল থেকে স্ত্রীসহ রাজধানীতে ভিক্ষা করতে এসেছেন লাল মিয়া নামে একজন বয়োবৃদ্ধ। তিনি বলেন, এলাকায় নিয়মিত ভিক্ষা করি না। রমজান মাসে রাজধানীতে ভিক্ষা করে অনেক টাকা পাওয়া যায়। এলাকার একজনের পরামর্শে স্ত্রীসহ ঢাকায় এসেছি। কড়াইল বস্তিতে আমার এক আত্মীয় থাকে, ওখানেই উঠেছি আমরা। সারাদিন বনানীর বিভিন্ন এলাকায় আমি আর আমার স্ত্রী মিলে ঘুরি। যা টাকা পাওয়া যায় তাতেই খুশি। রমজান মাসে মানুষ দান খয়রাত বেশি করে। আমরাও কিছু পাচ্ছি।

এদিকে গুলশান ২ এর মূল রাস্তা ছেড়ে ভেতরের দিকের এক সড়কে সিগন্যালে দাঁড়ানো একটি প্রাইভেটকারের কাচ নামিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে এক ব্যক্তি যখন একজন ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিচ্ছিলেন তখন তাকে ঘিরে ধরে আরও ৭৮৭ জন ভিক্ষুক। সবাইকে টাকা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন তিনি।

কথা হলে মুকিদুর রহমান নামে ওই ব্যক্তি বলেন, হঠাৎ করে ভিক্ষুক বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। গাড়ির জানালা খুলেছি একজনকে টাকা দেওয়ার জন্য, সাত-আট জন ঘিরে ধরল। বাধ্য হয়ে সবাইকেই টাকা দিলাম। এ সিগন্যালের সামনে ১৫ জন ভিক্ষুক দেখলাম। অন্য সময় এখানে দুই-একজনকে দেখা যেত।

গত ২ দিনে রাজধানীর গুলশান, বনানী, তেজগাঁও, নতুন বাজার ও মিরপুর এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করেন ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। 

আজও (বৃহস্পতিবার) বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এর আগে গতকাল বুধবার গুলশান, বনানী, তেজগাঁও, নতুন বাজার ও মিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ৯৭ জন ভিক্ষুককে এবং এর আগের দিন মঙ্গলবার ৭০ জন ভিক্ষুককে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুলকার নায়ন বলেন, ঢাকার বিভিন্ন এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করার পরও সম্প্রতি ওইসব এলাকায় ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গুলশান-বারিধারা এলাকায় বিদেশি নাগরিকদের হয়রানি করতে দেখা যাচ্ছে। আমরা অভিযান শুরু করেছি, এটি অব্যাহত থাকবে।

এএসএস/এমএ