ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে সড়ক ও রেলপথে। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতে তিলধারণের ঠাঁই থাকে না। হাজার হাজার মানুষ টিকিট ছাড়াও ট্রেনে উঠে বসেন। অনেকে নেন স্ট্যান্ডিং টিকিট, অনেকে তাও নয়। কারণ, স্ট্যান্ডিং টিকিটও পাওয়া যায় না।

ঈদ যাত্রার শুরুতে টিকিটবিহীন যাত্রী ঠেকাতে রেলের কর্মকর্তারা তৎপর থাকলেও শেষ দিকে মানুষের ঢলের সামনে হাল ছেড়ে দেন তারা। প্রতিবারই দেখা যায়, শেষ মুহূর্তে সব বাধা ঠেলে ট্রেনের ভেতরে ও ছাদে উঠে বসেন অনেক যাত্রী। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এবারের ঈদযাত্রার শেষ দিকেও এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে। সব ট্রেনে বাড়বে ‘অবৈধ’ যাত্রী।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেনগুলোতে প্রতিদিন ৩৩ হাজার ৫০০টি আসনের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেনের নন-এসি কোচের বিপরীতে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট (ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকিট) বিক্রি করছে তারা। সার্ভার থেকে যার একটি টিকিটও বেশি বিক্রির সুযোগ নেই। ফলে স্ট্যান্ডিং টিকিটের সংখ্যা আসলে কম।

এক ট্রেনে স্ট্যান্ডিং টিকিট কতটি? 

রেলওয়ে প্রশাসনিকভাবে ২টি অঞ্চলে বিভক্ত। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। রেলওয়ের তথ্যমতে পশ্চিমাঞ্চলে ২৯ জোড়া এবং পূর্বাঞ্চলে ২৭ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। উদাহরণ হিসেবে আমরা একটি ট্রেনের আসন সংখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারি। 

পদ্মা সেতু হয়ে রাজশাহী-ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলাচল করে আন্তঃনগর মধুমতি এক্সপ্রেস (৭৫৫/৭৫৬) ট্রেন। এই ট্রেনে কোচ সংখ্যা মোট ১২টি। এর মধ্যে ২টি শোভন শ্রেণীর আসন যুক্ত ডাইনিং কারে (ডব্লিউইসিডিআর) ৫৪টি করে ১০৮টি, একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কারে (ডব্লিউজেসিসি) ৮০টি, একটি প্রথম শ্রেণীর নন এসি ক্যাবিন কোচে (ডব্লিউএফসি) ৪৮টি, একটি শোভন শ্রেণীর আসনসহ পাওয়ার কারে (ডব্লিউইপিসি) ১৬টি, ৭টি শোভন চেয়ার শ্রেণীর কোচে (ডব্লিউইসি) ৯২টি করে মোট ৬৪৪টি আসন আছে। পুরো রেকে (ট্রেনে) মোট আসন ৮৯৬টি।

সেই হিসাবে এই ট্রেনের ক্যাবিন ও এসি কোচ ছাড়া মোট নন-এসি কোচের আসন রয়েছে ৭৬৪টি। এর বিপরীতে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিটের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯১টি। এই ট্রেনটি চলতি পথে ঢাকা স্টেশন ছাড়া গন্তব্য পর্যন্ত মোট ২১টি স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিটি স্টেশনের স্ট্যান্ডিং টিকিট সংখ্যা হয় ৯টি। তার মানে, ট্রেনটিতে আসনসহ ও আসন ছাড়া মোট এক হাজার ৮৭ জন বৈধ যাত্রী ভ্রমণ করতে পারেন।

স্ট্য্যান্ডিং টিকিটও পাওয়া যায় না

ট্রেনের আসন না পেয়ে কেউ যখন বিরক্ত, তখনও তিনি প্রত্যাশা করেন ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিটের একটি টিকিট অন্তত সংগ্রহ করতে পারবেন। কিন্তু কাউন্টারে যাওয়ার পর তিনি যখন জানতে পারেন কোনো স্ট্যান্ডিং টিকিট নেই, তখন টিকিট না নিয়েই ট্রেনে চড়ে বসেন তিনি। হয়ে যান ট্রেনের একজন ‘অবৈধ’ যাত্রী।

দেশের কয়েকটি রেলওয়ে স্টেশন ছাড়া বাকি রেলওয়ে স্টেশনগুলো অরক্ষিত। ফলে হর-হামেশােই যাত্রীরা সেসব স্টেশন থেকে বিনা বাধায় ট্রেনে উঠতে ও নামতে পারেন।

শুক্রবার সকালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কাউন্টারের সামনে কিশোরগঞ্জগামী একটি ট্রেনের টিকিট প্রত্যাশী মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদকের। স্ট্যান্ডিং টিকিট না পেয়ে তিনি বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, অনেক চেষ্টা করেও ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে পারিনি। ভেবেছিলাম ট্রেন ছাড়ার আগে কাউন্টারে এসে স্ট্যান্ডিং টিকিট পাব। কিন্তু কাউন্টার থেকে জানিয়ে দিল কোনো টিকিট নেই। 

তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে তো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। দাঁড়িয়ে যাওয়ার স্ট্যান্ডিং টিকিট কেন পাব না আমি। অথচ পুরো ট্রেন ভর্তি হয়ে যাত্রী যায়।

স্ট্যান্ডিং টিকিট না পেয়ে কাউন্টারগুলোর সামনে ঘুরছিলেন পঞ্চগড়গামী একটি ট্রেনের টিকিট প্রত্যাশী মোহাম্মদ নেসারুল আলম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, টিকিট পাইনি তো কী হয়েছে। কোনোভাবে ট্রেনে উঠতে পারলে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। জরিমানার টাকা দিয়ে যেতে পারব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বুকিং সহকারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন তো সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি হয়। আমরা শুধু ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট কাউন্টার থেকে ট্রেন ছাড়ার আগে আগে বিক্রি করি। ট্রেন ভেদে কোনো কোনো স্টেশন পর্যন্ত স্ট্যান্ডিং টিকিটের সংখ্যা হয় ৩ থেকে ১০টি মাত্র। কিন্তু যাত্রীরা এটি বুঝতে চান না। তারা মনে করেন আমরা তাদেরকে ইচ্ছা করে টিকিট দিই না। স্ট্যান্ডিং টিকিট না পেয়ে তারা নানা বাজে কথা বলেন, গালি দেন। 

ঈদ উপলক্ষ্যে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের প্রথম অংশে মোট ৭টি টিকিট কাউন্টার খোলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি কাউন্টার আন্তঃদেশীয় ট্রেনের টিকিটের জন্য বরাদ্দ। বাকি ৬টি কাউন্টার আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটের জন্য বরাদ্দ। এসব কাউন্টার থেকে যাত্রার আগে ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি করা হয়।

অবৈধ যাত্রীরা জরিমানা দিয়ে বৈধ হয় 

অবৈধ যাত্রী প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৮৯০ সালের যে আইন তার ১১২, ১১৩ ও ৬৮ ধারা মোতাবেক টিকিটবিহীন যাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় করা হয়। জরিমানাসহ ভাড়া আদায়ের পর তারা ওই ট্রেনটিতে বৈধভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন। কিন্তু যাদেরকে জরিমানা ও ভাড়ার আওতায় আনা যায় না, তারা অবৈধ যাত্রী। উৎসবের সময় ট্রেনে এমনিতেই ‘অবৈধ যাত্রী’ বাড়ে।

তিনি বলেন, প্রতি মাসে ঢাকা ডিভিশনে অন্তত দেড় কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়। আমাদের লোকবল খুব কম। এজন্য আমরা ইন্টার-সিটি ট্রেনেই শুধু টিটিই দিতে পারি। তাও সব ট্রেনে দুই-একজনের বেশি টিটিই দেওয়া সম্ভব হয় না। গত নভেম্বর মাসে শুধু জরিমানা থেকে ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এসেছে।

রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নন-এসি কোচের বিপরীতে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি করা হয়। এরপরও যারা ট্রেনে উঠে যান, তাদের কিন্তু হঠাৎ করে নামিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এরা অবৈধ যাত্রী। আমরা ট্রেনে যদি তাদের পাই তাহলে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় করি।

ট্রেনে অবৈধ যাত্রী ও স্ট্যান্ডিং আসন নিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েট অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেনের চাহিদা ব্যাপক, কিন্তু সেই অনুযায়ী যোগান নেই। সবাই ট্রেনে যাতায়াত করতে চায়। কয়েকটি স্টেশন ছাড়া বাকিগুলো অরক্ষিত। টিকিট ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ করা যায়- এটা যাত্রীদের একটা কালচার হয়ে গেছে। যাত্রীরা জানে ট্রেনের স্টাফদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা যায়। এই সুযোগটা যাত্রী ও রেলওয়ের রানিং স্টাফ সবাই নিয়ে থাকেন। ফলে রাজস্ব হারায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। 

তিনি বলেন, ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী উঠলে কোচগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে পরিমাণ ভাড়া ওই কোচ থেকে উঠে আসে, তার চেয়ে বহুগুণ টাকা রেলওয়ের খরচ হয় সেটি মেরামত করতে। যদি বিনা টিকিটে ভ্রমণের কালচার বন্ধ করা যায় এবং রানিং স্টাফরা নিজ দায়িত্বে অটল থাকেন তাহলে অতিরিক্ত যাত্রী ট্রেনে উঠতে পারবে না।

এমএইচএন/এমএসএ