‘আমার বাসায় দুটি মেয়ে সাবলেট থাকে। ওরা ঈদের ছুটিতে কয়েকদিন আগে বাড়ি গেছে। ওদের যেন কোনোভাবে হয়রানি করা না হয়। ওরা এই ঘটনায় জড়িত নয়।’

রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানা এলাকার তালতলা মোল্লাপাড়ার যে বাসা থেকে বাবা-ছেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখান থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেই চিরকুটে লেখা ছিল ওই বাসায় সাবলেটে থাকা দুই তরুণীকে যেন হয়রানি করা না হয়।

পুলিশের ধারণা, বাবা মশিউর রহমান (৫০) প্রথমে মেয়েকে হত্যার চেষ্টা করেন, এরপর ছেলেকে শ্বাসরোধে হত্যার পর নিজে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মশিউর রহমান ও ছেলের মরদেহ উদ্ধার করা হলেও মেয়েটি এখনো জীবিত আছে। মুমূর্ষু অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে সে।

ছেলে ও মেয়েকে হত্যা চেষ্টার পর কেন নিজে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন মশিউর? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ।

পুলিশ বলছে, মোটা অঙ্কের টাকার ঋণের বোঝা আর উত্তরায় কেনা একটি প্লটের দখল না পাওয়া নিয়ে হতাশায় ভুগছিলেন মশিউর। এ হতাশা থেকেই হয়তো এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন তিনি।

রোববার (৭ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে স্থানীয় ও স্বজনদের দেওয়া খবরে রাজধানীর শেরে বাংলানগর থানার পশ্চিম কাফরুল (তালতলা) মোল্লাপাড়ার ১৭১ নং বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটের বিছানা থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ছেলে মোদাব্বির রহমান সাদাফকে (১৬)। একই বাসার একই কক্ষের সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় মশিউর রহমানের মরদেহ। পাশের কক্ষে তখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিল মেয়ে সিনথিয়া।

বাড়ির ম্যানেজার আব্দুল মালিক ভূঁইয়া

ওই বাসার কেয়ারটেকার মো. মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন বছর ধরে মশিউর রহমান এ বাড়ির দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। ফ্ল্যাটের তিনটি রুম। দুটি রুমে তারা থাকতেন এবং মাঝখানের একটি রুম দুই তরুণীর কাছে সাবলেট দিয়েছেন।

তিনি বলেন, রোববার দুপুরে মশিউর রহমানের স্ত্রী ডলি আক্তার টিউশনি করাতে বাসা থেকে বের হন। বিকেল ৪টার দিকে তিনি বাসায় ফেরেন। এক ঘণ্টা ধরে দরজায় ধাক্কাধাক্কি, ডাকাডাকি ও কলিং বেল টিপে সাড়া না পাওয়ায় আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। ম্যানেজারের নির্দেশে আমি নিজেও সেখানে যাই। সাড়া না পেয়ে পেছন দিক দিয়ে গ্রিল ডিঙ্গিয়ে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে মেয়েটিকে লাঠি দিয়ে নাড়া দিলে দেখি সে জীবিত আছে। কিন্তু উঠতেও পারছিল না, কথাও বলতে পারছিল না।

পরে মা মজিদা খাতুন ডলি দরজা ভাঙার কথা বলেন। দরজা ভেঙে ভেতরে গিয়ে দেখি মেয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। আর ভেতরের রুমে মশিউর রহমান ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছেন। বিছানায় পড়ে আছে ছেলের মরদেহ। এরপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। আর মেয়ে সিনথিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

কেন এই ঘটনা ঘটল, কিছু জানেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু করেছে বলে শুনিনি। কখনো তো তাদের মধ্যে কোনো গ্যাঞ্জামের খবরও পাইনি। কালও তো দেখলাম চকলেট নিয়ে বাসায় ফিরছে। ম্যানেজার ভাড়া চাইছিল। বলছিল আজকে রাতে দেবে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত মশিউর রহমান বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বাউতলার কুদ্দুস মন্ডলের ছেলে। তিন বছর ধরে তিনি ওই বাসায় ভাড়া থাকেন। মশিউর রহমান ডিপ্লোমা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পাশাপাশি শেয়ার ব্যবসা করতেন। স্ত্রী ডলি আক্তার একসময় একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে এলাকায় টিউশনি করান। প্রতিদিনের মতো ঘটনার দিন দুপুরে টিউশনিতে গিয়েছিলেন তিনি।

কেয়ারটেকার মো. মোস্তফা

ওই বাড়ির ম্যানেজার আব্দুল মালিক ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, মশিউর রহমান শেয়ার ব্যবসায় ক্রমাগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিলেন। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। শুনেছি নিজের ভাগনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। সেই টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ ছিল। তাছাড়া তিনি নাকি উত্তরায় একটি প্লট কিনেছেন। কিন্তু সেটি বেদখলে আছে। সেটা নিয়েও চাপে ছিলেন।

শেরেবাংলা নগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আহাদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবা-ছেলের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় নেপথ্যের কারণ খুঁজছে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে—ছেলেকে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা করেন মশিউর। মেয়েটিকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সুরতহাল শেষে দুজনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

ঘটনাস্থল থেকে মশিউর রহমানের হাতে লেখা একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করা হয়েছে উল্লেখ করে ওসি আহাদ বলেন, ওই নোটে লেখা ছিল, বাসায় দুই তরুণী সাবলেট থাকেন, তারা এ হত্যার সঙ্গে জড়িত নন। তারা অনেক আগেই ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছেন। তাদের যেন হয়রানি করা না হয়। পাশাপাশি বাসার একটি টেবিলের ওপর থেকে কালো রঙের একটি দড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।

ওসি বলেন, ঋণ থাকার কথা শুনেছি। শেয়ার বাজারেও নাকি তার টাকা লগ্নি করা ছিল। সব মিলিয়ে তিনি হতাশায় থাকতে পারেন। তবে এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হবে। তাছাড়া মশিউর কেন এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন, আদৌ তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না সেটিও তদন্তের আগে বলা ঠিক হবে না। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মশিউর ছেলে ও মেয়েকে হত্যার চেষ্টা করে নিজে রশিতে ঝুলে আত্মহনন করেন। ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া মেয়ে সিনথিয়ার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

সরেজমিনে দেখা যায়, রোববার রাত ১১টার দিকে ফ্ল্যাটটিতে কাজ করছেন সিআইডির সদস্যরা। সুরতহাল ও ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহের পর শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশ ফ্ল্যাটটিতে তালা দিয়ে দেয়।

ভবনটির নিচতলার ভাড়াটিয়া সোমা আক্তার বলেন, তারা তিন বছর ধরে ভাড়া থাকলেও ওই ফ্ল্যাটে তাঁদের যাতায়াত ছিল না।

জেইউ/এসকেডি