রাষ্ট্রপতির আত্মীয় ও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করা এক প্রতারককে তার দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন, প্রতারক চক্রের মূলহোতা আব্দুল আজিজ ওরফে রাসেল (৫৫), তার অন্যতম দুই সহযোগী মো. নুরুল হুদা (৬৪) ও লুৎফর রহমান রতন (৪৮)।

গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের কাগজ, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্ট ও নকল সিল জব্দ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএমপির রমনা থানায় এক ভুক্তভোগীর করা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিবি।

ডিবি সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর কল্যাণপুরের অরভী ওভারসীসের মালিক মোহাম্মদ খালিকুজ্জামান হিরা। সম্প্রতি প্রতারক রাসেলের সঙ্গে পরিচয় হয় হিরার। হিরার কাছে নিজেকে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আত্মীয় বলে পরিচয় দেন রাসেল। রাসেল হিরাকে বলেন, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে চান। হিরা তার প্রস্তাবে রাজি হন। হিরা রাসেলকে ৫০টি ভিসার জন্য ৭০ লাখ টাকা দেন।

জানা যায়, এসব পাসপোর্টে ভুয়া ভিসা দিয়ে হিরার কাছে দেন রাসেল। কিন্তু ভিসা ভুয়া হওয়ায় কোনো শ্রমিক অস্ট্রেলিয়ার যেতে পারেনি। ফলে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে দেখেন আজিজ ও তার সহযোগীরা সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। শুধু হিরা নয় আজিজের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক ট্রাভেল ব্যবসায়ী ও রিক্রুটিং এজেন্সি।

মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল)  দুপুরে রাজধানীর মিন্টু রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ।

মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, রাষ্ট্রপতির গ্রামের বাড়ি পাবনায়। তার এলাকার আব্দুল আজিজ (৫৫) নিজেকে রাষ্ট্রপতির আত্মীয় ও অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক পরিচয়ে দিয়ে বিদেশে চাকরির ভিসা দেওয়ার নামে বিভিন্ন ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আজিজের অন্যতম সহযোগী নুরুল হুদা। মাঠ পর্যায়ে তাদের হয়ে কাজ করেন ফারুক, তুহিন, সরোয়ারসহ বেশ কয়েকজন এজেন্ট। 

তারা বিভিন্ন ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের ভিসা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেন। আজিজের কথিত গ্রামীণ ট্রাভেলসের মাধ্যমে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভিসা দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেন। আর নিজেকে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বিশ্বাস করাতে আজিজ অস্ট্রেলিয়ার একটি ফোন নাম্বার ব্যবহার করে খোলা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। তিনি সবাইকে বলতেন তিনি অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন এবং নুরুল হুদা হলেন তার বাংলাদেশি প্রতিনিধি।

তিনি বলেন, ট্রাভেল ব্যবসায়ীরা অস্ট্রেলিয়ার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দেখে বিভ্রান্ত হয়ে তাকে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী হিসেবেই বিশ্বাস করে। তারা বিভিন্ন মানুষদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা এনে আজিজের কাছে দেন ভিসা পাওয়ার আশায়। প্রতারক আজিজ তাদের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিস গুটিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। আর এই সকল টাকা নিতে ব্যবহার করা ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয় ভুয়া এনআইডি কার্ড ও ঠিকানা দিয়ে। ফলে তাকে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী সহজেই খুঁজে পেত না।

ডিবি প্রধান বলেন, আজিজ ১৯৬৮ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। রাজধানীর কাকরাইলে ভিশন-২০২০ নামের একটি মাইক্রোক্রেডিট নামের একটি ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। সেই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মানুষের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এরপর ২০২০ সাল থেকে নুরুল হুদার সঙ্গে গ্রামীণ ট্রাভেলস এজেন্সি থেকে অস্ট্রেলিয়া-কানাডা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর কথা বলে প্রতারণার জাল বিস্তার করতে শুরু করেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বলে সবাইকে পরিচয় দিতেন। আর নুরুল হুদা তার দেশীয় প্রতিনিধি। তার দেশীয় কিছু সহযোগী বিভিন্ন এজেন্টদের কাছে গিয়ে গ্রামীণ ট্রাভেলসের মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দিতেন। আজিজ নিজের নামে রেজিস্টার্ডকৃত কোন কিছুই তিনি ব্যবহার করেন না। সকলেই জানেন তিনি অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন। ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া কোটি কোটি টাকা নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতেন। প্রতারক আজিজের বিরুদ্ধে পাঁচটি ও নুরুল হুদার বিরুদ্ধে দুটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

তিনি বলেন, ভিসা দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন ট্রাভেল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন প্রতারক আজিজ ও তার চক্র। এই টাকা দিয়ে আজিজ রাজধানীতে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে সেই সকল প্রতিষ্ঠানের নাম। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর এলাকায় ক্যাফে রেট্রো, মহাখালীর ডিওএইচএস এলাকার ৬ নম্বর রোডের ১১৬ নম্বর বাড়িতে এরিস্টোক্রেট ইন্টারন্যাশনাল এন্ড টিএ এন্টারপ্রাইজ, মিরপুর-১০ নম্বর এলাকার আলোক হাসপিটালের পেছনে তার হেলথ প্রডাক্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বায়োব্লু লিমিটেড, গ্রামীণ ট্রাভেলস, এয়ার প্রজেক্ট এভিয়েশন, গ্রামীণ এয়ার ট্রাভেলস, প্রাণ গ্রুপের ডিলার, গ্রামের বাড়িতে ফিশারিজসহ বিভিন্ন প্রজেক্টে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

এমএসি/এমএসএ