অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত হাজারো বিড়ম্বনা। তবুও স্বজনদের সান্নিধ্য পেতে বাড়ি ফেরার ব্যাকুলতা আর উচ্ছ্বাস বলে দেয় ঘরে ফেরার আনন্দ কতটা। যারা শত বিড়ম্বনা-ভোগান্তি উপেক্ষা করে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছেন বলতে গেলে তাদের সবাই হয় গুনগুন করে গাইছেন অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো ছবির সঙ্গে লিখছেন– ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’...।

ঈদের ছুটিতে পরিবারের বা আপন মানুষের সান্নিধ্য পেতে সবাই বাড়ি ফিরছেন। বাবা ফিরছেন সন্তানের কাছে, সন্তান ফিরছেন বাবা-মায়ের কাছে। যান্ত্রিক জীবনে কিছুটা বিরতি দিয়ে যখন সবাই বাড়িতে ফেরেন, সে এক অন্যরকম অনুভূতি। এই অনুভূতিটি ঘরেফেরা মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। তার ওপর ভিত্তি করে রচিত একটি গান ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’।

বিজ্ঞাপন চিত্রের থিম সং (জিঙ্গেল) থেকে দেশের মানুষের ঘরে ফেরার থিম সংয়ে পরিণত হয়েছে এই গান। ২০০৯ সালের দিকে গ্রামীণফোনের একটি বিজ্ঞাপনের জন্য এ গানে সুর বাঁধেন হাবিব ওয়াহিদ, সংগীত আয়োজনও ছিল তার। গ্রামীণফোনের তৎকালীন কর্মকর্তা আনিকা মেহজাবীনের কথায় গানটিতে কণ্ঠ দেন শিল্পী মিলন মাহমুদ। অল্প সময়ে গানটি দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

মিলন মাহমুদের কণ্ঠে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ প্রকাশের সাত বছর পর ২০১৬ সালে গ্রামীণফোনের ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ বিজ্ঞাপনের থিম সংয়ের সুর ও সংগীত আয়োজন করেন হাবিব ওয়াহিদ। এই গানটি লেখেন রাসেল মাহমুদ। আর গানটিতে কণ্ঠ দেন মিঠুন চক্র। বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের পর গানটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়, মানুষের মনে স্থান করে নেয়।

দ্বিতীয় গানটিতে মানুষ এতটাই আবেদন খুঁজে পেয়েছেন যে এখন ঈদযাত্রা বলতেই সামনে আসে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’। তাই তো যাত্রা পথে অনেকে এই গান গাইছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ লিখছেন। গানটির কথায় ও সুরে আছে গভীর এক মায়া। এতে মানুষের ঘরেফেরার আকুতি উঠে এসেছে। যে কারণে ১৫ বছর পরও বিজ্ঞাপন চিত্রের থিম সংটি আলাদাভাবে ঠাঁই নিয়ে আছে মানুষের মনে।

গানটির শুরুর কথা নিয়ে আলাপ হয় আনিকা মেহজাবীনের সঙ্গে। তখন তিনি গ্রামীণফোনের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গানটি মূলত তারই লেখা।

গানটি লেখার স্মৃতি তুলে ধরে আনিকা মেহজাবীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেই সময় আমি গ্রামীণফোনে কাজ করি। প্রথমে আমি তিনটি লাইন লিখলাম। পরে আমার বসকে সেটি শোনালাম। গানের কথা লেখার পর যোগাযোগ করা হলো হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গে। তার ম্যানেজার জানালেন তিন-চার দিনের মধ্যে তিনি দেশের বাইরে যাবেন, যা করতে হবে দ্রুত। এরপর গায়ক মিলন মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। স্টুডিওতে বসে তৈরি করা হলো গানটি। শুনে প্রথমে আমার অফিসের লোকজনই বলল দারুণ হয়েছে। পরে এটি দিয়ে টিভিসি তৈরি হলো। আমরা সিডিতে রেকর্ড করে বাসে লঞ্চে ট্রেনে এগুলো দিলাম। আর তখন থেকেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল গানটি।

এর পরের ঘটনা ২০১৬ সালের। তখন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্রিয়েটিভ বিভাগে কর্মরত রাসেল মাহমুদ পুরোনো গানটির আদলে নতুন করে লিখলেন।

গানটি নিয়ে ঢাকা পোস্টকে রাসেল মাহমুদ বলেন, ২০১৬ সালে আমি তখন কাজ করি গ্রে অ্যাডভার্টাইজিংয়ে। সুযোগ হলো ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ আবার ফিরিয়ে আনার। আনিকা মেহজাবীনের কথায়, হাবিব ওয়াহিদের সুরে ও মিলন মাহমুদের গাওয়া স্বপ্ন যাবে বাড়ি গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল আগেই। আবার আমার ওপর দায়িত্ব এলো সেই অনুভূতিকে ফিরিয়ে আনার।

তিনি বলেন, এরপর লিখে ফেললাম গানের কথা। হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে কয়েক দফায় সুর নিয়ে বসলাম। সে সময় আমরা এমন একটি কণ্ঠ খুঁজছিলাম যে কণ্ঠে কাঁচা মাটির আবেগ পাওয়া যায়। এরকম চিন্তা থেকেই বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা মিঠুন চক্রকে গানটি গাইতে বললেন হাবিব ওয়াহিদ। চমৎকার গাইল মিঠুন চক্র। আমাদের সবার মনে ধরে গেল। গানটি প্রকাশ পাওয়ার পর মানুষের আবেগের বিষয়টি এখন সবার জানা। প্রতিবার ঈদ এলে মানুষ এই গানটি শোনেন, দেখেন, শেয়ার করে নিজের অনুভূতির কথা অন্যদের জানান।

রাসেল মাহমুদ বলেন, বিশেষ করে প্রবাসীরা আরও বেশি আবেগ তাড়িত হযন গানটি দেখে বা শুনে। গানটি মানুষের মনে এতটা জায়গা করে নেবে, মানুষ এতটা ভালোবাসা দেবে এই গানকে, যা ভাবলে আসলেই খুব ভালো লাগে। তবে একটা জিনিস একটু খারাপ লাগে, গানটি সীমাহীন ভালোবাসা পেয়েছে কিন্তু গীতিকার, স্ক্রিপ্ট রাইটারদের সাধারণত কেউ মনে রাখে না। অনেকেই জানে না যে এটা আমার লেখা। তবুও নিজের কাছে ভালো লাগে, আমার লেখা গান মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে। এটা অবশ্যই অনেক ভালো লাগার, অনেক আবেগের বিষয়।

২০১৬ সাল থেকে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ শিরোনামে যে গানটি চলছে সেটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন মিঠুন চক্র। তখন মিঠুন চক্রকে সেভাবে কেউ চিনত না। মিঠুন চক্র বাদ্যযন্ত্র নিয়ে থাকতেন কিন্তু গানে কণ্ঠ দিতেন না। তবুও হাবিব ওয়াহিদ চেয়েছিলেন এই ভয়েসটাকে এক্সপেরিমেন্ট করতে।

গানটি নিয়ে কথা হয় শিল্পী মিঠুন চক্রর সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমাকে যখন প্রথমে হাবিব ভাই বললেন তুমি গানটি গাও। আমি গাইলাম। ভেবেছিলাম এটা ডামি ভয়েস হবে। আমারটাই যে থাকবে এটা আমি প্রথমে ভাবতেই পারিনি। আমার গাওয়াটা ভালো লাগল সবার, আয়োজকদেরও। তবে বেশিরভাগ মানুষই জানে না এই গানটি আমার গাওয়া। বিভিন্নজন এই গানটির গায়ক হিসেবে বিভিন্নজনকে মনে করে। যখন কোনো স্টেজ প্রোগ্রামে যাই, যখন আমি বলি যে একটা গান শুনাই, গানটা আমার করা। এরপর যখন স্বপ্ন যাবে বাড়ি গানটি গাই, তখন সবাই জিজ্ঞেস করে বিষয়টা। এই গানটি আমার শুনে অবাক হয়। তখন ভালোবাসা দেয় সবাই, প্রশংসা করে, এটা ভালো লাগে। কিন্তু আমারই করা গান, এটা সেভাবে কেউ জানেই না। গানটি সীমাহীন ভালোবাসা পেয়েছে মানুষের। গানটি যে আমার করা সেটি না জানলেও মানুষের যে আবেগের জায়গা, অনুভূতির জায়গা, সীমাহীন ভালোবাসার জায়গায় এ গান স্থান করে নিয়েছে তাতেই আমার ভালো লাগা, এতেই মন ভরে যায়।

ইট-পাথরের শহর ছেড়ে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ। অগ্রিম টিকিট প্রাপ্তি থেকে শুরু করে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত পদে পদে ভোগান্তি। দীর্ঘ যানজট, শিডিউল বিপর্যয়, টিকিটের অপ্রতুলতা, ভোগান্তি সব উপেক্ষা করে যখন মানুষ স্বজনদের কাছে পৌঁছাতে পারে, তখন মনে আলাদা প্রশান্তি কাজ করে। আর যাত্রা পথে প্রতিটি মানুষই ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ এই গানটির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে বাড়ি ফেরেন। গানটি যেন কোনো কোম্পানির নয়, বিজ্ঞাপনের নয়; এ গান কেবল বাড়ি ফেরা মানুষের, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ-অনুভূতি।

ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া রাজশাহীগামী বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী হয়েছেন সাজ্জাদুল ইসলাম নামে একজন। রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। নির্দিষ্ট দিনে দীর্ঘ চেষ্টার পর কাঙ্ক্ষিত দিনের ঈদের ট্রেনের টিকিট পেয়েছিলেন। আজ যখন ঢাকা ছেড়ে নিজ এলাকা রাজশাহীতে যাচ্ছেন, তখন তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই গানটি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি…।’

এ বিষয়ে সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ঈদে বাড়ি ফেরা এমন কোনো মানুষ মনে হয় নেই যে এই গানটি সম্পর্কে জানে না। বাড়ি ফেরার সময় সবার মনে মনে এই গানটি বাজে। আবার কেউ কেউ স্ট্যাটাস দিয়ে এই গানটির কথা জানান দেয়। এটা আসলে খুবই ভালো লাগার আবেগের অনুভূতির বিষয়। যে কারণে আমি নিজেও স্ট্যাটাস দিয়েছি- স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে থাকেন উত্তরবঙ্গের ছেলে শামীম আহমেদ। স্বপ্ন যাবে বাড়ি গানটি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা যারা প্রবাসে থাকি, ঠিকমতো বাড়ি যেতে পারি না, ঈদে স্বজনদের দেখা পাই না। যখন এই গানটা দেখি বা শুনি, অটোমেটিক্যালি চোখে পানি চলে আসে, নিজের আবেগকে এই গানের সঙ্গে মিলিয়ে নিই। আবার যখন নিজেদের বাড়ি ফেরার সুযোগ আসে, ঈদ করতে যাওয়ার সুযোগ আসে তখন আমরা নিজেরাও এই গান গাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই গানের ভিডিও শেয়ার দিই, স্ট্যাটাস দিই। গানটি আসলেই মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

এএসএস/এসএসএইচ