রাজধানীর লালমাটিয়া-১১ নম্বর সড়কের ফুটপাতে পড়েছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন সাত মাসের এক অন্তঃসত্ত্বা। ছিল শারীরিক নানা জটিলতা। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্বেচ্ছাসেবী সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার।

গত বছরের ২৮ জানুয়ারি উদ্ধারের সময় মানসিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল—নিজের নামও বলতে পারেননি তিনি। উদ্ধারের পর তার নাম দেওয়া হয় ফাতেমা। কল্যাণপুর চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে আনার তিনমাস পরই ছেলে সন্তানের জন্ম দেন ফাতেমা। মা-ছেলের পাশাপাশি চলে শুশ্রূষা ও মানসিক চিকিৎসা।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন ফাতেমা। কোথাও যাওয়ার জায়গা না পাওয়া ফাতেমা থাকেন ওই আশ্রমে। পরিবার বিচ্ছিন্ন ফাতেমা আজ আশ্রমটির হাতেই পেয়েছেন নতুন জীবন—স্বামী, সংসার ও চাকরি।

উদ্ধারের এক বছর পর গত ২৬ জানুয়ারি নতুন রঙে বদলে যায় ফাতেমার জীবন। ধুমধাম আর নানা আয়োজনে তার বিয়ে হয়। বর—চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের কর্মী মিরাজ হোসেন। এখন ফাতেমার চোখজুড়ে নতুন স্বপ্ন। এবারের ঈদটা তাই ফাতেমার কাছে বিশেষ কিছু।

আশ্রম সূত্রে জানা যায়, ফাতেমার স্বামী মিরাজের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। বাবা মৃত বজলুর রহমান পাটোয়ারী। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মিরাজ। গত পাঁচ বছর যাবত ওয়ার্ড বয় হিসেবে চাকরি করছেন ওই প্রতিষ্ঠানে।

ঈদের দিন বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কল্যাণপুর পাইকপাড়ায় (বাড়ি-৪৬২, সড়ক-৮ দক্ষিণ পাইপাড়া) ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, দুজনই কাজে ব্যস্ত। ফাতেমা রান্নায় সহায়তা করছেন, স্মৃতিশক্তি হারানো আশ্রিত নারীদের শুশ্রূষা করতে দেখা যায় মিরাজকে।

এর ফাঁকে কথা হয় দুজনের সঙ্গে। ফাতেমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি সুখে আছি। আমি পরিবার হারা মানুষ। নিজের স্মৃতিশক্তিও ছিল না। এখানে আনার পর আমাকে সুস্থ করা হয়। বিয়ের মধ্য দিয়ে আমাকে সংসারও উপহার দিয়েছেন মিল্টন দাদা। শুধু তাই নয় চাকরিও দিয়েছেন এখানে। আমি এখন স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যতের। যেখানে বিচ্ছিন্ন ভাবনা থাকবে না, ভালবাসা থাকবে। সেটা আমি পাচ্ছি মিরাজের হাত ধরে।

পরিবার, বাবা-মায়ের পরিচয় না জানিয়ে ফাতেমা বলেন, আজকে ঈদের দিন। অত্যন্ত ভালোলাগার দিন। আমি যখন অসুস্থ হয়ে ফুটপাতে পড়ে ছিলাম বাড়ির কেউ খবর নেয়নি। স্মৃতিহীনতায় একটা ভয়াবহ সময় পার করেছি। আজ আমার পরিবার আছে, সন্তান আছে, স্বামী আছে, ঈদের আনন্দ আছে। একটু পর আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘুরতে বের হবো।

আশ্রম সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ জানুয়ারি দুপুরে রঙ-বেরঙের আলোকসজ্জায় সাজানো হয় আশ্রমের ভেতর-বাহির। ছাদে তৈরি করা হয় বর-কনের জন্য সুসজ্জিত মঞ্চ।

বিয়ের মূল আয়োজন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের হলেও এমন বিয়ের খবরে সাহায্যের হাত বাড়ান দেশি-বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীরা। 

মিরাজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফাতেমাকে যখন লালমাটিয়া থেকে তুলে আনা হয়, তখন অবস্থা খারাপ ছিল। ভারসাম্যহীণ ফাতেমার মাথায় জট ছিল। এখানে আনার পরও অনেক যন্ত্রণার মধ্যে সময় গেছে। অন্তঃসত্ত্বা ফাতেমার চিৎকার করতো, কারো কথা শুনতো না। বিছানায় পায়খানা-প্রস্রাব করতো। শুধু আমার সঙ্গেই কথা বলতো, আমার কথা শুনতো। আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসে, সুস্থ হতে থাকে ফাতেমা। ফাতেমা জানায়, আমাকে পছন্দ করে। সে কথা শুনে মিল্টন ভাই বাড়িতে কথা বলেন। এরপর বিয়ের ব্যবস্থা করেন।

মিরাজ বলেন, ওর যে কেউ নাই বিষয়টি এমন না কিন্তু বিচ্ছিন্ন ছিল। যোগাযোগ ছিল না। কেউ খবর রাখতো না। এখানে আসার পর সুস্থ হয়ে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। অনেকে অনেক কিছু মনে করেছে। দূর থেকে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু কাছে থেকে সমাধান করতে কয়জন পারে?

ফাতেমার স্বামী বলেন, ফাতেমা তো ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। এখন সে সুস্থ। ওর সংসার হয়েছে। ওর মতো মেয়েকে বিয়ে করাও তো ভাগ্যের ব্যাপার। ওর জন্যও ভালো যে বিচ্ছিন্ন জীবন থেকে বেড়িয়ে পরিবার পেয়েছে।

আমি ফাতেমার সঙ্গে আছি, থাকবো। বাকিটা জীবন আমরা এক সঙ্গেই থাকতে চাই। আজকে ঈদের দিন। সে গতবছরও ট্রমায় ছিল। আমিও ভাবিনি ফাতেমার জীবন বদলে যাবে। এই বদলে আমি মিরাজ অংশীদার। এটা ভালোলাগার।

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে এক বৃদ্ধার শুশ্রূষা চলছে। ছবি- ঢাকা পোস্ট

মিল্টনের মুখে ফাতেমা উদ্ধারের গল্প

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মিল্টনের স্ত্রী মিঠু হালদারকে তার এক বন্ধু জানান, লালমাটিয়ার ১১ নম্বর সড়কের ফুটপাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পড়েছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন ফাতেমা। এরপরই সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে নিয়ে আসেন মিল্টন।

তিনি বলেন, ‘উদ্ধারের সময় তার জ্ঞান ছিল না। পায়ের একটি ক্ষতে পোকা হয়ে গিয়েছিল। মাথা ভর্তি জট, নোংরা শরীর। উদ্ধারের পর জানা যায়, মারাত্মক পুষ্টিহীনতা ও রক্ত শূন্যতায় ভুগছে সে। এরপর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আর দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে ফাতেমা।’

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা মিলটন সমাদ্দার বলেন, ফাতেমা এখন সংসার করছে। মিরাজ-ফাতেমার বিয়েতে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় টিভি, ফ্রিজ, খাট, সোফা, আলমারিসহ সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই। দুজন যেন মিলেমিশে সংসার চালাতে পারে, সে জন্য ফাতেমাকেও এখানে কাজ দিয়েছি। দুজন এখানে থাকছে। মানুষ মানুষের জন্য, বিচ্ছিন্নতা অশান্তির-কষ্টের। সম্পর্ক, বন্ধনই শান্তির সুখের ভালোবাসার, সেটি আবারো প্রমাণিত ফাতেমা-মিরাজের জীবনে। 

জেইউ/এমএসএ