মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার মুখে ২০১৭ সালে ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে/ ফাইল ছবি

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর দেশটিতে এখন পর্যন্ত দুজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গত বছরের আগস্টে সেখানে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়। তাকে নতুন কর্মপরিকল্পনা দেওয়া হয়। আগেরজনকে একেবারেই দূতাবাস-কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে আবদ্ধ রাখা হয়েছিল। এখন নতুন রাষ্ট্রদূত দূতাবাসের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যু ও সম্পর্ক উন্নয়নের কাজ করছেন সমানতালে।

ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূতের কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে সরকারের ইচ্ছায়। সরকার চায়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ দ্বিপাক্ষিক অন্যান্য বিষয়ে ইয়াঙ্গুনে থাকা রাষ্ট্রদূত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক। সেই লক্ষ্যে কাজও করছেন রাষ্ট্রদূত। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন তি‌নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির লড়াই রো‌হিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যতোটা অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তৈ‌রি করেছে, তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। 

২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন কূটনীতিক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী। ইয়াঙ্গুনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি করোনা মহামারির কারণে দূতাবাসের ভেতরে একরকম আটকা পড়েন। কোথাও ‘মুভ’ করতে পারেননি। এছাড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা নেওয়ার পর রাষ্ট্রদূতকে কোথাও যেতে ঢাকা থেকে অনুমতি নিতে হতো। সরকারের পক্ষ থেকে সেনা শাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রদূতকে নিরুৎসাহিত করা হয়।

অন্যদিকে গত বছরের (২০২৩) আগস্ট থেকে মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পান পেশাদার কূটনীতিক ড. মো. মনোয়ার হোসেন। শুরু থেকে বেশ সরব ভূমিকায় দেখা যায় এ কূটনীতিককে। প্রায় নয় মাসের দায়িত্বে দূতাবাস সামলানোর পাশাপাশি সেনাশাসিত মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। এছাড়া দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছেন মনোয়ার হোসেন।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়াঙ্গুনে দায়িত্ব পালন করা এক কূটনীতিক বলেন, দুই রাষ্ট্রদূতের কাজ নিয়ে পার্থক্য করা সম্ভব নয়। কারণ, আগের রাষ্ট্রদূতকে কোথাও যেতে হলে অনুমতি নিতে হতো। তিনি দায়িত্বে থাকার সময়ে কোভিড পিরিয়ড ছিল। পুরো বিশ্ব এক ধরনের বন্দি অবস্থায় ছিল। মিয়ানমারেও বহুদিন কোথাও বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে তাকে মুভ না করতে বলা হয়েছে। এখন যিনি দায়িত্বে আছেন তিনি খুবই অ্যাকটিভ। তার চেষ্টা আছে এবং পরিস্থিতি তার অনুকূলে। কারণ সরকার তাকে ওখানে ‘মুভ’ করার মেসেজ দিয়ে পাঠিয়েছে।

ইয়াঙ্গুনের কূটনীতিকের সঙ্গে সহমত পোষণ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, করোনাকালীন সময়ে যিনি দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি দুই বছর একরকম বন্দি ছিলেন। তার তেমন কিছু করার ছিল না। ওনাকে যখন দায়িত্বে পাঠানো হয় তখন সেখানে সামরিক সরকারের সময়। আমাদের সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল তাদের সঙ্গে এনগেজমেন্ট করবে কি করবে না। আগের রাষ্ট্রদূতের তো কোনো অনুষ্ঠানে যেতেও ঢাকা থেকে অনুমতি নিয়ে যেত হতো। কারণ তাদের সরকারের সঙ্গে কোন লেভেলে কতটুকু মিট করা হবে আমাদের এটা নিয়ে কনফিউশন ছিল। যেমন- তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো সামরিক কর্মকর্তা, তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে কি যাবে না এটা নিয়ে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। আমাদের এখান থেকেও বলা হয়েছে বেশি মেলামেশার দরকার নেই।

এ কূটনীতিক বলেন, এখন যিনি দায়িত্বে আছেন তার ক্ষেত্রে সে ধরনের বাধা নেই। তাকে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে, যোগাযোগ বাড়াতে। তিনি তার দায়িত্ব পালন করছেন। এটা বলা যেতে পারে বর্তমান রাষ্ট্রদূতের চেষ্টা আছে।

পররাষ্ট্র ক্যাডারের ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিম খান চৌধুরীর পাঁচ বছর সময়কাল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনের মধ্যে রাষ্ট্রদূতকে সীমাবদ্ধ রেখেছে সরকার। এর বাইরে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে খোঁজ-খবর বা প্রতিবেদন পাঠাতেন সদর দপ্তর ঢাকায়। অবশ্য তার সময়ে যে কয়েকবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, বেশিরভাগ ছিল ভার্চুয়ালি।

কূটনীতিক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী বর্তমানে ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৩-এর ৮ মে থেকে তিনি তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে রয়েছেন।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে উপস্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করা পেশাদার কূটনীতিক মনোয়ার হোসেন গত বছরের (২০২৩) জুলাই মাসে রাষ্ট্রদূত হয়ে ইয়াঙ্গুনে যান। ইয়াঙ্গুনে যাওয়ার মাসখানকের মধ্যে পরিচয়পত্র পেশ করে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী মাঠে নেমে পড়েন রাষ্ট্রদূত। 

এখন পর্যন্ত প্রায় নয় মাস রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন মনোয়ার হোসেন। এই সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো পালনের পাশাপাশি সেনা শাসিত মিয়ানমার সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এছাড়া সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ করে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে দেশটির ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক; বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন, মিয়ানমারের বিভিন্ন দপ্তরের গুরত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি।

এছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে ঝুলে থাকা কোস্টাল শিপিং চালু নিয়ে পুনরায় আলোচনা, বিমান যোগা‌যোগ, মিয়ানমারের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের বৃত্তি দেওয়ার উদ্যাগ, মিয়ানমারে থাকা আসিয়ানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ইয়াঙ্গুনে অবস্থিত বিমসটেক দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের একটি ইনফরমাল গ্রুপ গঠনে ভূমিকা রাখা ছাড়াও আরও বেশ কিছু কর্মযজ্ঞে রাষ্ট্রদূতকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।

ঢাকার দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরি। তবে সেটা ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য উদ্যোগের চেয়ে বেশি জরুরি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে। ঢাকার চাওয়া, দূতাবাস রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রাষ্ট্রদূত এ ল‌ক্ষ্যে কাজ কর‌ছেন। 

এনআই/জেডএস/পিএইচ