সোমালিয়ান জলদস্যুর কবলে পড়া এমভি আব্দুল্লাহর পাশ দিয়ে উড়ে যায় একটি বিমান। চক্কর দিতে থাকে জাহাজের আশেপাশে। এসময় ২৩ নাবিককে জাহাজের ডেকে নিয়ে এসে এক লাইনে দাঁড় করায় দস্যুরা। পেছন থেকে নাবিকদের দিকে অস্ত্র তাক করে ছিল দস্যুরা।

এরপর বিমান থেকে নাবিকদের হাত নাড়তে ইশারা করা হয়। নাবিকরা হাত নাড়ানোর পর বিমান থেকে একে একে তিনটি ডলারভর্তি ব্যাগ ফেলা হয়। ডলারের ব্যাগ পেয়ে উল্লাস করতে থাকেন জলদস্যুরা।

মূলত ওই ব্যাগে ছিল জলদস্যুরদের দাবি কার মুক্তিপণের ডলার। মুক্তিপণ পাওয়ার পরে জলদস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। এরপর সোমালিয়া উপকূল ছেড়ে আসে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ।

৩১ দিন পর জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়া একাধিক নাবিক পরিবারের সদস্যরা ঢাকা পোস্টকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

যদিও কেএসআরএমের পক্ষ থেকে মুক্তিপণের বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে।

মুক্তিপণ পাওয়ার পর সোমালিয়ার সময় শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৮ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় শনিবার দিবাগত রাত ৩টা ৮ মিনিট) জাহাজটি থেকে দস্যুরা নেমে যায়।

এরপরই জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আল হারমিয়া বন্দরের উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় এমভি আবদুল্লাহর দুই পাশে দুটি যুদ্ধজাহাজ পাহারা দিয়ে সোমালিয়া উপকূল ত্যাগ করতে থাকে।

মুক্ত হওয়া একজন নাবিক তার পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন, ছোট বিমান থেকে জাহাজের পাশে পানিতে ডলারভর্তি ব্যাগ ফেলা হয়। বিমানটি চক্কর দিতে দিতে ব্যাগ তিনটি ফেলা হয়। জাহাজের পাশে আগে থেকেই স্পিডবোটে করে অপেক্ষায় ছিল দস্যুরা। একে একে ব্যাগগুলো ফেলার সময় চিৎকার করে উল্লাস করছিল তারা। ডলারভর্তি ব্যাগ পানি থেকে সংগ্রহ করে আট ঘণ্টা পর গভীর রাতে দস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে যায়।

শনিবার বিকেলে মুক্তিপণের অর্থ পেলেও দস্যুরা তাৎক্ষণিকভাবে জাহাজ থেকে নেমে যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, জলে-স্থলে নজরদারি এড়াতেই গভীর রাতে দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের সময় জিম্মি জাহাজটির অদূরে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ। আবার স্থলভাগে ছিল সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড পুলিশের টহল।

এদিকে বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ ও জিম্মি ২৩ নাবিকের মুক্তিতে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কোনো মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তার দাবি, তাদের সঙ্গে (জলদস্যুদের) নেগোসিয়েশন করা হয়েছে। নানামুখী চাপ ছিল, সেগুলো কাজে দিয়েছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করেছি, দীর্ঘদিন কথাবার্তা চলেছে। এখানে মুক্তিপণের কোনো বিষয় নেই। আমাদের আলাপ-আলোচনা এবং বিভিন্ন ধরনের চাপ আছে এখানে। সেই চাপগুলো কাজে দিয়েছে।’

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী জানান, দর-কষাকষি চূড়ান্ত হওয়ার পরই মুক্তিপণের অঙ্ক পৌঁছানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। দস্যুরা নগদ ডলার ছাড়া নাবিকদের মুক্তি দেয় না। সে জন্য উড়োজাহাজে করে নগদ ডলার পৌঁছে দিতে হয় জিম্মি জাহাজের পাশে। আফ্রিকা অঞ্চলে এ রকম ছোট এয়ারক্রাফট পাওয়া যায়, যেগুলো খুব নিচু এলাকা দিয়ে উড়তে পারে।

রোববার চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে এমভি আব্দুল্লাহর মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের অফিসে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া ২৩ নাবিক আগামী ২০ এপ্রিল দেশে ফিরতে পারেন। আগামী ১৯ এপ্রিল দুবাই পৌঁছাতে পারে জাহাজটি। সেখান থেকে উড়োজাহাজে আসবেন চট্টগ্রামে।  

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানের উপ-মহাব্যবস্থাপক শাহরিয়ার জাহান রাহাত। জিম্মি নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে জানান তিনি। ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ উদ্ধারে অভিযান চালানোর পরিকল্পনাকেও নিরুৎসাহিত করা হয় বলে জানান তিনি। 

এর আগে গত ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হারমিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজটি জিম্মি করার পর সোমালিয়ার গদভজিরান জেলার জেফল উপকূলের কাছে নিয়ে যায় দস্যুরা। ৯ দিনের মাথায় দস্যুরা প্রথম মুক্তিপণের দাবি জানায়। প্রায় দুই সপ্তাহ দর-কষাকষির পর মুক্তিপণের অঙ্ক চূড়ান্ত হয়।

আরএমএন/এসকেডি