এক সময় ঘটা করে পালন করা হতো চৈত্র সংক্রান্তি ও হালখাতা উৎসব। বৈশাখের প্রথম দিনে ‘লাল খাতায়’ হতো এ উৎসব। তবে কালের বিবর্তনে অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে বাংলা নববর্ষের এই আমেজ। রাজধানীর পুরান ঢাকায় কিছু ব্যবসায়ী পুরাতন এই ঐতিহ্যটিকে ধরে রাখলেও হালখাতা উৎসবের জৌলুস দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির আধিপত্যের কারণে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী হালখাতা উৎসবের আনন্দ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষ করে ব্যাংক লেনদেনের কারণে ‘জানুয়ারি টু ডিসেম্বরে’ চলে গেছে ‘চৈত-কাবারি’ হিসাব।

রোববার (১৪ এপ্রিল) উৎসবমুখর পরিবেশে সারা দেশে পালিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১। বর্ষবরণের হাওয়া লেগেছে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজারের ব্যবসায়ী মহলেও। স্বল্প পরিসরে কিছু মোকামঘর ও গদিতে লালখাতায় শুরু হয়েছে তাদের ব্যবসায়িক বছর।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, শ্যামবাজার, ইসলামপুর এলাকায় হালখাতা উৎসবকে ঘিরে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ধোয়ামোছার কাজ করানো হয়েছে। সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা হয়েছে দোকানের সরঞ্জাম। অনেকে আবার ক্রেতা-বিক্রেতার পুরনো পাওনা চুকিয়ে নববর্ষের প্রথম দিনে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য দোকানে মিষ্টি এনে রেখেছেন। অনেক ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়মিত ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে গত ১০ বছরে হালখাতা উৎসবের এই আয়োজন অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হালখাতার উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়া কম্পিউটারের মাধ্যমে হিসাব করার ফলে লাল কাপড়ে বাঁধাই করা হিসাব খাতার চল কমে গেছে। এখন অনেকটা নিয়ম রক্ষার জন্যই হালখাতার আয়োজন করা হচ্ছে। সাধারণত মুসলিম ব্যবসায়ীদের নিমন্ত্রণপত্রে মসজিদের মিনার, আর হিন্দু ব্যবসায়ীদের নিমন্ত্রণপত্রে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি সম্বলিত দাওয়াতপত্র এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে এখনও কিছু ব্যবসায়ী পুরাতন ঐতিহ্যটি ধরে রেখেছে।

বৈশাখের প্রথম দিনে হালখাতা উপলক্ষ্যে ধুয়ে মুছে সাজানো হয়েছে বাবুবাজারের বিথি নাকফুল হাউজ। পুরনো খাতার বদলে দোকানে উঠানো হয়েছে নতুন খাতা। খাতার প্রথম পাতায় লাগানো হয়েছে পয়সার সিল, লেখা হয়েছে নানা ধর্মীয় বাণী। এছাড়াও প্রথম দিনে নিয়মিত ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে।

নতুন বছরের এই আয়োজন প্রসঙ্গে দোকানটির স্বত্বাধিকারী শুভ্রত কর্মকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, হালখাতার উৎসবটা পুরান ঢাকায় এখনও আছে, তবে এবার ঈদের ছুটির কারণে আয়োজনে কিছুটা ভাটা পড়েছে। ঈদের ছুটি শেষে কর্মচারীরাও আজ থেকে কাজ শুরু করেছে। যেকারণে খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন পর্যন্ত আমার ব্যবসায় আয়োজনে ভাটা পড়েনি। তবে দিন যেভাবে পাল্টাচ্ছে, আগামী দিনে এরকম উৎসব আয়োজন হবে কি-না সেটা বলা মুশকিল।

তিনি বলেন, যেকোনো পুরনো আয়োজন দিনদিন লোপ পাচ্ছে, সেটা প্রযুক্তির কারণেই হোক বা মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তনের কারণেই হোক। আজকে আমি আয়োজন করেছি কিন্তু আগামী বছর কী হয়, সেটা আমি বলতে পারছি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে হালখাতা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আগের যে ঐতিহ্যটা ছিল, সেখান থেকে আমরা অনেকটাই দূরে সরে এসেছি।

মেসার্স ময়ূরী জুয়েলার্সের ব্যবসায়ী বিশাল নন্দী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত বয়োজ্যেষ্ঠ যারা আছেন, তারাই মূলত হালখাতা প্রথার উপর বিশ্বাসী। আমাদের মত নতুন প্রজন্মের যারা আছি, তারা এখন টালি খাতার পরিবর্তে কম্পিউটারাইজড সিস্টেমে হিসেব রাখেন। আরেকটি বিষয় হলো এখন কিন্তু আগের দিনের তুলনায় বাকিতে বিক্রি অনেকটাই কমে গেছে। এখনকার ক্রেতারা যাই কেনেন, নগদ টাকায় কেনেন। এসব কারণেই আমাদের আসলে আয়োজন করে হালখাতা করার প্রয়োজন হয় না।

পহেলা বৈশাখের উৎসব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শহরকেন্দ্রীক যারা বসবাস করে, শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই এখন পহেলা বৈশাখের আয়োজনটা দেখা যায়। আয়োজনটিকে ঘিরে এখন নানা রকম সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মীয় মতপার্থক্যটা এখন প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে, যা আগে এতোটা ছিলো না। মানুষের মধ্য থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। এবছর উৎসব আয়োজনে কমতি থাকার আরেকটি কারণ হলো ঈদের ছুটি। ঢাকার অধিকাংশ মানুষই ঈদের ছুটিতে দেশের বাড়িতে চলে গেছে, যারা এবারের বৈশাখ আয়োজন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

শাঁখারিবাজারের শাঁখা, সিঁদুরসহ পূজার দ্রব্যাদি বিক্রয় প্রতিষ্ঠান মা পদ্মা শঙ্খ ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী নকুলেশ্বর নাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, হালখাতার জাঁকজমকতা এখন অনেকটাই কমে গেছে। আমাদের হালখাতায় সাধারণত এক বছরের হিসাব হয় কারিগর আর মহাজনের মধ্যে। কারিগররা দোকানে আসে, মহাজনের সাথে হিসাব নিকাশ করে, তাদের প্রাপ্য টাকা নিয়ে যায়। সময় দুই পক্ষের মধ্যে মিষ্টিমুখ করানো হয়, সাধারণ কিছু উৎসব হয়। কিন্তু এখন বর্তমান যা পরিস্থিতি, কারিগরের সংখ্যা এখন অনেক কমে গিয়েছে। আগে যেখানে ২০০ জন ছিল, সেখানে বর্তমানে আছে মাত্র ১০ জন। যে কারণে মহাজনের ব্যবসাটাও এখন কমে গিয়েছে, ফলে উৎসব আয়োজনেও অনেকটা ভাটা পড়ে গেছে।

তিনি আরও যে কোন উৎসব আয়োজনই এখন সীমিত হয়ে গিয়েছে। অন্যতম কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সব ধরনের জিনিসই এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। সবাই এখন অল্পতেই কাজ শেষ করতে চায়। পূজা-পার্বণে যেখানে মানুষ আগে ১০ টাকা খরচ করতো, এখন সেখানে দুই টাকাতেই শেষ করে ফেলার চিন্তা করে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সনাতন হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারোটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। আরও জানা যায়, অতীতে জমিদারকে খাজনা প্রদানের অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পূণ্যাহ’ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাকআশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় ‘পূণ্যাহ’ বিলুপ্ত হয়েছে।

‘পূণ্যাহ’ বিলুপ্ত হওয়ার পর বাংলা সনের প্রথম দিন দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার জন্য শুরু হয় হালখাতা। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০-১১ মার্চ সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন হয় তৎকালীন ভারতবর্ষে। সময়ের পরিবর্তনে হালখাতার হাল আগের মতো না থাকলেও চিরায়ত এই অনুষ্ঠানটি এখনও হারিয়ে যায়নি। যদিও এখন কেবল স্বর্ণালঙ্কারের দোকানেই এ প্রথা পালিত হতে দেখা যায় বেশি। বিশেষ করে ঢাকার আদি ব্যবসায়ী পরিবারে মহাসমারোহে পালিত হয় এই রীতি।

টিআই/পিএইচ