নিহত পাভেল / ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর পল্লবীর সুখনগরের একটি পুকুর থেকে পাভেল খান (২৫) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধারের পর তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। মূলত পূর্বের ক্ষোভ মেটাতেই পাভেলকে কুপিয়ে পানিতে ফেলে হত্যা করে আসামিরা। 

পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় গ্রুপিং নিয়ে পাভেল ও হাবিবের মধ্যে মারামারি হয়েছিল। সেই সময় হাবিবের হাতে কোপ দিয়েছিল পাভেল। ওই ঘটনায় ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাড্ডা থানায় মামলাও দায়ের হয়। পাভেল জেল খাটলেও ক্ষোভ মেটেনি হাবিবের। সুযোগ বুঝে কোপের বদলা নিতে পরিকল্পনা করতে থাকে হাবিব। ২/৩ বার চেষ্টা করেও ভেস্তে যায় সেই পরিকল্পনা।

নতুন করে পরিকল্পনা করে হাবিব। গত ১৪ এপ্রিল বিকেলে মাদক সেবনের জন্য তানজীব নামে আরেক সহযোগীর মাধ্যমে রাজধানীর বাড্ডার পাঁচতালা বাজার এলাকার বাসা থেকে ডেকে মোটরসাইকেলে করে পাভেলকে নেওয়া হয় পল্লবীতে। পরে ১২ নম্বর সেক্টরের স্বপ্ন নগর আবাসিক এলাকার টেকেরবাড়ি নামক স্থানে গণপূর্তের পুকুরের উত্তরপাড়ে মাদকও সেবন করেন পাভেল। এর মধ্যে সন্ধ্যার দিকে ঘটনাস্থলে বাসযোগে আসে হাবিবসহ আরও কয়েকজন। সবাই একসঙ্গে পাভেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চাকু ও ছুরি দিয়ে পেট ও পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৪৫টি আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। এরপর তাকে গণপূর্তের পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় সবাই।

ওই ঘটনায় মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) রাতে মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ। আসামিরা হলেন, মূল পরিকল্পনাকারী মো. হাবিব (২৮), মো. হানিফ(২৬), মো. আনিছ (২২)। তাদের বরিশালের মেহেদীগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া, মামলার আসামি না হলেও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনায় জড়িত সোহান ও সাবদ্দিন নামে অপর দুজনকে ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে গ্রেপ্তারা করে পল্লবী থানা পুলিশ।

বুধবার (১৭ এপ্রিল) তাদের আদালতে সোপর্দ করা হলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় হাবিব। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাকি চারজনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। 

থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পাভেলের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টা উপজেলায়। বাবার নাম শায়েস্তা খান। পাভেল থাকতেন বাড্ডার পাঁচতলা বাজার এলাকায়। পাভেল বাসচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। মায়ের ভাষ্য মতে, ভাড়ায় মোটরসাইকেলও চালাতেন পাভেল। 

গত ১৫ এপ্রিল মা পারুল বেগম বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজহারভুক্ত আসামি ছয়জন। তারা হলেন, মো. হাবিব (২৮), মো. হানিফ (২৬), মো. আনিছ (২২), রায়হান নানু (২২), মো. মিলন (৩৭), ও মো. জনি (২৬)। বাকি আরও ৫/৬ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। 

পাভেলের মা পারুল বেগমের দায়ের করা মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে গত ১১ এপ্রিল গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায় যান তিনি। তবে, ঢাকায় থেকে যান দুই ছেলে পাভেল ও তমাল। গত ১৪ এপ্রিল পাভেল বাসা হতে বের হলে এক আসামি হাবিব মোটরসাইকেলে করে ঘোরার জন্য নিয়ে যায়। একপর্যায়ে গত ১৪ এপ্রিল রাত ৮টার সময় সকল আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫/৬ জন পরস্পর যোগসাজশে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পাভেলকে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে।

পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী, পাভেলের পিঠে ছোট বড় ২২টি, মাথায় ৮টি ধারালো অস্ত্রের ক্ষত-বিক্ষত আঘাতেন চিহ্ন পেয়েছে পুলিশ। আর মাথার পেছনে প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা আঘাতের চিহ্ন, কোমড়ে চারটি ধারালো অস্ত্রের ক্ষত দেখা গেছে। পাভেলের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট বড় মোট ৪৫টি ধারালো অস্ত্রের ক্ষত-বিক্ষত আঘাত দেখেছে পুলিশ। 

পাভেলের মা পারুল বেগম বলেন, আমি গত ১২ বছর যাবত বাড্ডায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছি। পাভেল আমার বড় ছেলে। পাভেল ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। সেই সূত্রে মামলার আসামিদের সঙ্গে আমার ছেলের পরিচয় ও চলাফেরা ছিল। 

তিনি বলেন, বাড্ডা এলাকায় মারামারি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা পরিচালনা, মাদক বিক্রয়সহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়। আমার ছেলে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর এগুলোতে বাধা দেওয়ায় মারামারি হয়। হাবিব বাদী হয়ে পাভেলের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় একটি মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় ১৮ দিন জেলহাজতে থেকে জামিনে মুক্তি পায় পাভেল।

তাড়াতাড়ি জামিনে বের হয়ে আসায় পাভেলের ওপর হাবিবসহ অন্যরা ক্ষিপ্ত ছিল বলে দাবি করেন পারুল বেগম। তিনি বলেন, পুনরায় শিক্ষা দিতেই আসামিরা বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখাতে থাকে পাভেলকে। আমার ছেলে পাভেল একরকম ভয়ে বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে থাকত। আমি গত ১১ এপ্রিল বাড়ি যাওয়ার পর ওরা আমার ছেলেটাকে মেরেই ফেলল।

এ বিষয়ে পল্লবী থানা পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাড্ডা এলাকার গ্রুপিং নিয়ে পাভেল ও হাবিবের মধ্যে মারামারি হয়। পাভেল কোপ দেয় হাবিবের হাতে। এই ঘটনায় ২০২৩ সালে ২৮ ডিসেম্বর বাড্ডা থানায় মামলা হয়। মামলা নম্বর ৬১। 

তিনি বলেন, ওই মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিল পাভেল। পরবর্তী সময়ে জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর থেকেই পাভেলকে মারার পরিকল্পনা করে আসছিল হাবিব। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই হাবিব পাভেলকে কোপানোর পরিকল্পনা করছিল। হাবিব তার এলাকার বন্ধু তানজীবের সহায়তায় পল্লবী স্বপ্ন নগর আবাসিক এলাকার পেছনে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে তারা মাদক সেবন করে। এরপর হাবিবসহ অন্যরা উপস্থিত হওয়ার পর চাকু আর ছুরি দিয়ে ৪৫টি স্টেপ করে পাভেলকে পানিতে ফেলে যায়। সেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পাভেলের মৃত্যু হয়। 

এক প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি যে, পাভেল নিজেও মাদক সেবন ও কারবারে জড়িত ছিল। এজন্য সে কখনো পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়নি। অন্যদিকে, হত্যাকাণ্ডের মামলায় গ্রেপ্তার ও পলাতক প্রত্যেক আসামির নামে একাধিক মামলা রয়েছে। আসামিরা স্বল্পশিক্ষিত। পাভেল হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হাবিব বাড্ডার সুবাস্তু টাওয়ারে একটি চাকরি করে।

জেইউ/কেএ