• উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা এর মধ্যেই রেকর্ড করেছে
• তাপপ্রবাহ আরও কয়েকদিন চলবে
• অতীতে মে মাসেও বাংলাদেশে তাপপ্রবাহের রেকর্ড আছে
• আফ্রিকার কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি হয়েছে
• জলবায়ু সহনশীল রাখতে ২৫ শতাংশ বনায়নের বিকল্প নেই

সকাল হতে না হতেই কড়া রোদ। ঘরের বাইরে বের হওয়ার আগে ভাবতে হচ্ছে মানুষকে। ঘরে ২৪ ঘণ্টা ফ্যান চললেও তা মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না। গ্রামে কৃষক, শহরে হকার-রিকশাওয়ালাদের মতো শ্রমজীবীরা হাঁপিয়ে উঠছেন অসহ্য গরমে। হিটস্ট্রোকে মানুষের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। 

গত কয়েকদিনের বাংলাদেশের আবহাওয়ার চিত্র এটি। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় গরমের তাপমাত্রা এর মধ্যেই রেকর্ড অতিক্রম করেছে। দু’দফায় জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্ট। সব মিলিয়ে ঈদের ছুটির পর শুরু হওয়া তাপপ্রবাহে কাহিল মানুষ। 

আবহাওয়ার বিরূপ এ আচরণ যে শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে তা নয়। বেসরকারি আবহাওয়া সংস্থা বিডব্লিউওটির প্রধান আবহাওয়াবিদ খালিদ হোসেন বলছেন, বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে অসহ্য গরম পড়ছে। এসব স্থানে প্রায় ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে। এর মধ্যে আফ্রিকার মালি, নাইজার ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তাপমাত্রা প্রায় ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রেকর্ড হচ্ছে। এ ছাড়া, মধ্য ও পূর্ব ভারতেও কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে রেকর্ড হচ্ছে।  

বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস বলছে, দেশে চলমান এই তাপপ্রবাহ আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে। চলতি মাসে তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই। গত কয়েকদিনের তুলনায় তাপমাত্রা গতকাল (মঙ্গলবার) কিছুটা কমলেও আবারও বাড়তে পারে বলেই মত আবহাওয়া অফিসের। দেশে এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ডও হতে পারে।  

তীব্র গরমে ঢাকার সড়কে পানি ছেটানো হচ্ছে

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে জানান, আগামী কয়েকদিনে তাপপ্রবাহের এলাকা কিছুটা কমে যেতে পারে, তবে তাপপ্রবাহ কমবে না। তিনি বলেন, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় তাপপ্রবাহ কমতে পারে। অন্যদিকে, খুলনা, রাজশাহী, ঢাকা, বরিশাল বিভাগের তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী এক সপ্তাহে চলতি সপ্তাহের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করার সম্ভবনা কম, তবে তাপপ্রবাহ থাকবে। সহসাই তাপপ্রবাহ শেষ হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।’

এরই মধ্যে এ মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 

বেড়েই চলেছে তাপমাত্রা
আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। গত বছরের ১৭ এপ্রিল ঈশ্বরদীতে রেকর্ড করা হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। ২০২১ সালের এপ্রিলে যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২১ সালের আগে, ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪৩.২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০ এপ্রিল এক সাথে দেশের অনেক জায়গায় ৪০ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।  

আবহাওয়াবিদ নাজমুল হক আরও বলেন, অতীতে মে মাসেও বাংলাদেশে তাপপ্রবাহের রেকর্ড আছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে মে মাসেও তাপপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এপ্রিল মাসেও কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত হয়নি। এপ্রিল মাসের স্বাভাবিক যে বৃষ্টিপাত, আজ পর্যন্ত তার চেয়ে ৬৮ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। অর্থাৎ মাসের ২৪ দিনে স্বাভাবিকের মাত্র ৩২ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবার মে মাসেও যদি স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম থাকে, তাহলে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে।  

যে কারণে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ
এই আবহাওয়াবিদ বলেন, জলবায়ু সহনশীল রাখতে ২৫ শতাংশ বনায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু অপরিহার্য হলেও সে অনুযায়ী বনায়ন নেই। আবার পরিবেশের কথা উপেক্ষা করেই বর্তমানে আমাদের রাস্তা-ঘাট তৈরি হচ্ছে। যেমন পিচের রাস্তা করলে সেখানে পর্যাপ্ত গাছপালা থাকা দরকার। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এ ছাড়াও আমরা নগরায়ন ঠিকই করছি, কিন্তু সবুজায়ন করছি না।

তিনি আরও বলেন, এরপর দেশের যানবাহনগুলোর কালো ধোঁয়াও দেশের আবহাওয়া পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে দায়ী। গাড়ির কালো ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলে মিশে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর সাথে শিল্পোন্নত দেশগুলো অধিক পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের ফলে আমাদের দেশের জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব পড়ছে। এইসব কারণে আবহাওয়া পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নানামুখী প্রভাব পড়ছে।  

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় থাকা দেশের মধ্যে একটি বাংলাদেশ। কিন্তু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার দিক থেকে বাংলাদেশের খুব বেশি কিছু করার নেই।
গরমে একটু স্বস্তির আশায় রাস্তায় শরবতে প্রাণ জুড়াচ্ছেন মানুষ, এসব শরবতে ব্যবহৃত পানির মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। 

এসব কারণেই আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।  

বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে উন্নত দেশগুলো 
বৈশ্বিক জলবায়ুর এই পরিবর্তনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বরাবরই উন্নত দেশগুলোকেই এর জন্য দায়ী করা হলেও কোনোকিছুতেই কর্ণপাত করে না শিল্পোন্নত দেশগুলো। প্রতিনিয়তই ইউরোপ-আমেরিকা বা চীনের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে পৃথিবীকে।  

মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের সমস্যা সমাধানের উপায় থাকলেও সমন্বিত উদ্যোগ নেয় না কেউই। 

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় থাকা দেশের মধ্যে একটি বাংলাদেশ। কিন্তু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার দিক থেকে বাংলাদেশের খুব বেশি কিছু করার নেই। কারণ সমস্যাটা বৈশ্বিক। সেটার সমাধানের জন্য উন্নত দেশগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে বাংলাদেশকে। যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মতো দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ না কমালে, পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। 

জলবায়ু পরিবর্তনের মূল আঘাত যাচ্ছে এশিয়ার ওপর দিয়ে
জাতিসংঘের বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ু নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএমও) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে— জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এশিয়া মহাদেশভুক্ত দেশগুলো। 

ডব্লিউএমও’র মতে, অন্যান্য মহাদেশের চেয়ে এশিয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব পড়েছে বেশি। এ কারণে এই মহাদেশের তাপমাত্রাও বাড়ছে। ১৯৯১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে এশিয়ার গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৮৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনকি ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর এশিয়ার গড় তাপমাত্রা ছিল দশমিক ৯১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। 

তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে সুস্থ থাকতে সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।

গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টানা ও দীর্ঘ তাপপ্রবাহে এক দিকে এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের হিমবাহগুলো গলে যাচ্ছে, অন্য দিকে জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে— যা অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের পানির নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ব্যাপক সংকট সৃষ্টি করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ডব্লিউএমও’র প্রতিবেদনে।

ডব্লিউএমওর শীর্ষ নির্বাহী কেলেস্টে সাউলো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এশিয়ার অধিকাংশ দেশের ইতিহাসে ২০২৩ সাল ছিল উষ্ণতম বছর। বিশ্বে খরা, তাপপ্রবাহ, ঝড়, বন্যার মতো যত বিপর্যয় ঘটেছে, সেসবের অধিকাংশই ঘটেছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। জলবায়ু পরিবর্তনের গভীর প্রভাব ইতোমধ্যে জনজীবন ও পরিবেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতিতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদি তাপমাত্রা বৃদ্ধি, হিমবাহ গলে যাওয়া এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই প্রভাব আরও ব্যাপক হবে।’ 

ডব্লিউেএমও’র তথ্য অনুয়ায়ী, তাপমাত্রা বাড়ছে সাইবেরিয়া থেকে মধ্য এশিয়া, পূর্ব চীন থেকে জাপান পর্যন্ত। জাপানের ইতিহাসে উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩ সাল। একই সঙ্গে এ সময় প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ এশীয় অংশের তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ।

এসআর/এনএফ