প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। এ তালিকায় রয়েছেন করোনার সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসকসহ বহু স্বাস্থ্যকর্মী। গত আট দিনে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও দশজন চিকিৎসকের নাম।

চিকিৎসকদের সংগঠন প্ল্যাটফর্ম অব মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল সোস্যাইটির তথ্য মতে, গতকাল (২৭ এপ্রিল) সন্ধ্যা পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, উপসর্গ নিয়ে বা ভাইরাস পরবর্তী জটিলতায় মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০ জনে।

গতকাল মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) করোনা আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন দুই চিকিৎসক। তাদের মধ্যে করোনার পরবর্তী জটিলতায় মারা গেছেন প্রখ্যাত চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হানিফ কবির। মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ডা. হানিফ কবির ছিলেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন : করোনায় অসম যুদ্ধে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা

এর পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে করােনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. ফরিদুল আলম রেজা শােকরানা। তিনি গত ১৫ দিন ধরে করােনার সঙ্গে লড়াই করে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ডা. ফরিদুল আলম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৮ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

গত ২০ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. আব্দুল মজিদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৫ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

গত ২২ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ সার্জন অধ্যাপক ডা. মো. ফজলুল হক। রাজধানীর গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

একইদিন (২২ এপ্রিল) করোনায় মারা যান মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘সন্ধানী’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ডা. খুরশিদ আলম অপু। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

২৪ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অনুজীববিদ অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান তুষার। তিনি রাজধানী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডা. একেএম শামছুজ্জামান তুষার রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। এছাড়াও কর্মজীবনে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (সিডিসি) ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ছিলেন।

আরও পড়ুন : হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে চিকিৎসকের মৃত্যু

২৫ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান গাজীপুর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের সহকারী সার্জন ডা. আশিষ কুমার বণিক। তিনি রাজধানী উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডা. আশিষ কুমার বণিক শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের ৪র্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৪২ বছর।

গত ২৫ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো হুমায়ুন কবীর মুকুল। তিনি রাজধানী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডা. মো হুমায়ুন কবীর মুকুল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। সর্বশেষ এই চিকিৎসক কিশোরগঞ্জের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ খান মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

২৬ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের পরিচালক ও হাসপাতালটির প্রধান কার্ডিয়াক অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডা. মাহবুবুল ইসলাম। ল্যাবএইড হাসপাতালেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডা. মাহবুবুল ইসলাম স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৪র্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।

একইদিন (২৬ মার্চ) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও ফিজিওলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. শামসুল হুদা। তিনি আইসিডিডিআর'বিতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ডা. শামসুল হুদা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী।

দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি

অল্প সময়ের ব্যবধানে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসকের মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসির অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।

তিনি বলেন, করোনায় আমরা অনেক বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসককে হারিয়েছি। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি হতে অনেক সময় ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। তারা দেশের সম্পদ। কষ্টের মধ্যেও গর্বের বিষয় হচ্ছে, জীবনের ঝুঁকি রয়েছে জেনেও সম্মুখসারির এই যোদ্ধারা পিছপা হননি, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিন কারণে সংক্রমিত হচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা

বিএমএ মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী মনে করেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ তিনটি। প্রথমত কে কে সংক্রমণমুক্ত, কে সম্ভাব্য করোনা রোগী এবং কে প্রকৃত রোগী— এটা বাছাই করার কোনো ব্যবস্থা হাসপাতালে নেই। দ্বিতীয়ত, শুরু থেকেই পিপিইর মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আবার সবাই পিপিই পাননি। যখন পেলেন, তখন তাদের ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তৃতীয়ত, অনেক ব্যক্তি করোনার লক্ষণের বিষয় চেপে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই ধরনের কথা বলেছে। তারা বলছে, সেবার একটি পর্যায়ে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা জানতে পেরেছেন, কে করোনা আক্রান্ত রোগী আর কে নয়। চিকিৎসকদের অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ বিভাগগুলোয় দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়। অনেক কর্মী সংক্রমণ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেন না (যেমন সঠিকভাবে পিপিই ব্যবহার করেন না বা অনেকের হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস নেই)। এছাড়া অনেকের প্রশিক্ষণেরও ঘাটতি আছে।

পিপিই বা মাস্ক নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা বিশেষ করে চিকিৎসকরা অভিযোগ করেছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে এমন পিপিই অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া হয়নি। জীবাণুরোধী মাস্কও অনেকে ব্যবহার করতে পারেননি। অন্যদিকে বিশ্বসেরা মাস্কের নামে নকল মাস্ক সরবরাহের অভিযোগ উঠেছিল।

এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও নাগরিক সংগঠন হেলথ ওয়াচ একটি জরিপ করে। ১৮ এপ্রিল প্রকাশ করা ওই জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ২৫ শতাংশ চিকিৎসক ও নার্স কোনো পিপিই পাননি। যারা পেয়েছিলেন, তারা পিপিইর মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না।

টিআই/এসকেডি