নির্মাণ শ্রমিক আব্দুল মালেকের বয়স এখন ৭০ ছুঁইছুঁই। ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন রাজধানীতে। দীর্ঘ এ সময়ে হাজার হাজার দালানকোঠা তৈরির কাজে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু নিজের মাথা গোঁজার কোনো ঠিকানা করতে পারেননি এ শহরে। বয়সের ভারে এখন ক্লান্ত তিনি। আগের মতো শক্তি নেই বলে প্রতিদিন কাজও পান না। মিলছে না ঠিকমতো তিন বেলা আহারও। কখন কাজ পাবেন এ আশায় থাকেন সারাক্ষণ। 

আব্দুল মালেক বলেন, গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর কর্মের খোঁজে ঢাকায় আসি। প্রথমে লেবারের কাজ করতাম। পরে নির্মাণ কাজ শুরু করি। কয়েক বছর কাজ করার পর মিস্ত্রি হই। পরে আস্তে আস্তে নিজেই ছোট ছোট বাড়ির কাজ নিয়ে করতে থাকি। এক সময় ৫০-৬০ জন লেবার আমার আন্ডারে কাজ করত। কত মানুষকে কাজ দিয়েছি। অনেক কন্ট্রাক্টর আছেন, যারা আমার কাছে কাজ শিখেছেন। অথচ এখন আমি নিজেই কাজ পাই না। বয়স হয়ে গেছে, এখন আর কেউ কাজে নিতে চায় না। মাঝে মধ্যে ছোট কাজ পেলে দুই-তিনশ টাকা মজুরি দেয়। কোনো মতে চলি। আর কাজ না পেলে না খেয়েই থাকতে হয়। গত এক বছর ধরে অনেক কষ্টে আছি। কাজ নাই। এমনও সপ্তাহ যায় একদিনও কাজ পাই না। না খেয়েও থাকতে হয়। কী করব? কারও কাছে হাত পাততে পারি না, কষ্ট লাগে, বিবেকে বাধে।

পরিবারে কে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবারের কেউ নেই। মা-বাবা মারা গেছে ৪০ বছর আগে। বিয়ে করেছিলাম। কোনো সন্তান নেই, স্ত্রীও মারা গেছে অনেক আগে। এখন একাই থাকি একটি বাসার ছাদে। কাজ পেলে ভাত জুটে, না পেলে না খেয়ে থাকি। এভাবেই চলছে। এখন মরলে বাঁচি।

আব্দুল মালেকের মতো লাখ লাখ শ্রমিক এখনও না খেয়েই দিন কাটায়। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে এই আধুনিক সভ্যতা। তারাই আজ অবহেলিত। নেই রাষ্ট্রের কোনো সহযোগিতা। পরিবারের আহার জোগাতে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দিন কাটে। অনেক কর্মহীন শ্রমিক কাজের জন্য চেয়ে থাকে। এভাবেই চলছে তাদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম।

আজ মেহনতি মানুষের দিন- পহেলা মে। প্রতিবছর মে দিবস আসে শ্রমজীবী মানুষের জাগরণের গান নিয়ে। সংগ্রামের ঐক্য ও গভীর প্রেরণা যোগায় দিনটি। তবে মহামারিতে তা বদলে গেছে। এখন মে দিবসে শ্রমিকের মলিন মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কাই বেশি। কারণ কাজ হারিয়ে বেকার অনেকে। শ্রমজীবী মানুষেরা এখন বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছেন। করোনার কারণে দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতের ৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা আজ হুমকির মুখে।

গত ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে চলমান বিধিনিষেধের কারণে রিকশাচালক, গাড়িচালক, দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, দোকানদার, ফুটপাতের ছোট ব্যবসায়ী— এমন খেটে খাওয়া কর্মজীবীরা বিপাকে পড়েছেন। পোশাক কারখানা খোলা থাকলেও স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও ছাঁটাই আতঙ্কে আছেন শ্রমিকরা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ উদ্যোগে চালানো এক জরিপের প্রতিবেদন বলছে, করোনার এক বছরে দেশের ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৬০ লাখ ধরলে করোনার প্রভাবে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার ফলে এ হার আবারও বাড়তে পারে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সারাদেশের নির্দিষ্ট কিছু লোকের ওপর তিন ধাপে এ জরিপ করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতি পাঁচ বছর পরপর জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতির ওপর জরিপ করে। ২০১৬ সালে সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ে খানা আয়-ব্যয় জরিপে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। ওই জরিপের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের প্রাক্কলনে দেখা গেছে, ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। অর্থাৎ করোনার আগেই দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ দরিদ্র ছিল। পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপের ভিত্তিতে প্রাক্কলন বিবেচনায় নিলে এখন দরিদ্র লোকের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি।

সভ্যতার উদয় যে শ্রমজীবী মানুষের রক্ত ঘামে রচিত হয়, তারা আজও সমাজ রাষ্ট্রে উপেক্ষিত, অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত জানিয়ে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আ ন ম শামসুল ইসলাম বলেন, শ্রমজীবী মানুষ যুগের পর যুগ অত্যাচারিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত, শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এটাই যেন তাদের ভাগ্যের নিয়তি।

শামসুল ইসলাম বলেন, আমরা কঠিন একটি সময় পার করছি। মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সারাবিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। এ দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী মানুষ। কর্ম হারিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। দিনমজুর ও দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমিকদের খাদ্য চাহিদা পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কর্মহীন মানুষের খাবারের চাহিদা পূরণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রত্যাশা সরকারসহ সামর্থ্যবানরা শ্রমজীবী মানুষের দাঁড়াবে। পাশাপাশি ঈদুল ফিতরের আগেই শ্রমিকের সব বকেয়া বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান এ শ্রমিক নেতা।

মে দিবস উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, আমরা বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস নামক অদৃশ্য এক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। সবার সহযোগিতা আর সচেতনতায় আমরা এ যুদ্ধে অবশ্যই জয়ী হব।
 
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী করোনা সংক্রমণের শুরুতেই চিন্তা করেছেন শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কথা। প্রথমেই তিনি শ্রমিক ভাইবোনদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে রফতানিমুখী শিল্পের মালিকদের প্রণোদনা/ঋণ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) করোনা মহামারির কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণে আমাদের নির্দেশনা প্রদান করেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা নিয়ে রফতানিমুখী শিল্প গার্মেন্টস এবং চামড়া শিল্পের কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের জন্য বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জার্মান ফেডারেলের সহযোগিতায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ১৫শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৩১ জন শ্রমিককে তিন মাসের বেতনের বাবদ ৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। এছাড়া শ্রম অধিদফতরের অধীন শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসকরা করোনা মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার ২৪১ জন শ্রমিককে চিকিৎসা সুবিধা দিয়েছে।

মহান মে দিবস

১৮৮১ সালে নভেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর সেখানে চতুর্থ সম্মেলনে গৃহীত হয় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, বলা হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে সব শ্রমজীবী মানুষ আট ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না। ওই দিনটিতে তাই পাঁচ লাখ শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে ধর্মঘটে যোগ দেন।

৩ মে ম্যাককর্মিক হার্ভাস্টার কারখানায় নির্মম পুলিশি আক্রমণ চলে, তাতে প্রাণ হারান ছয়জন নিরীহ শ্রমিক। পরের দিন অর্থাৎ ৪ মে হে মার্কেট চত্বরে আয়োজিত হয় এক বিশাল প্রতিবাদ সভা। পুলিশ এই সভায় গুলি চালালে শহীদের রক্তে রাঙা হয় হাতের পতাকা। গ্রেফতার করা হয় চারজন শ্রমিক নেতাকে। বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন, জারি করা হয় ফাঁসির আদেশ।

দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে এই নৃশংস বর্বরতার খবর পৌঁছায় দুনিয়ার সব মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের কানে। ১৮৮৯ সালে জুলাই মাসে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথমদিনের অধিবেশনেই সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয় যে ১৮৯০ সালে ১ মে থেকে প্রতিবছর শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি, সৌভ্রাতৃত্ব ও সংগ্রামের দিন হিসেবে এই দিনটি পালিত হবে। এভাবেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবস ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক মে দিবসে পরিণত হয়।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে পহেলা মে’কে মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।

এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে- ‘মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ, মুজিববর্ষে গড়ব দেশ’। করোনা মহামারির কারণে এ বছর জনসমাগম সংশ্লিষ্ট সব বহিরাঙ্গন কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন। জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।

এসআই/এসএসএইচ