মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

#ঈদের দিন সারাদেশে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অবস্থান কর্মসূচির প্রস্তুতি
#৫০ লাখ পরিবহন শ্রমিকের ঈদ-আনন্দ মাটি
#পেটের দায়ে দূরপাল্লার বাস চালাচ্ছেন কেউ কেউ
#ভ্রাম্যমাণ দালালদের খপ্পরে ঈদযাত্রীরা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জারি করা বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেটসহ বিভিন্ন মহাসড়কে বাসে ঈদযাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে অনেকটা লুকোচুরি করে। নিষেধাজ্ঞায় রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলো থেকে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হলেও আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে দূরপাল্লার কিছু বাস ছেড়ে যাচ্ছে। ঈদের আগে বাড়ি যেতে এসব বাসে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে।

সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নৌপথে যাত্রীর ঢল আর বুধবার বাংলাবাজার ঘাটে পাঁচ জনের প্রাণহানির পর মহাসড়কে বিকল্প যানবাহনে বাড়ি যাওয়ার প্রবণতা আরও বেড়েছে। ঈদও ঘনিয়ে এসেছে, তাই যাত্রীর চাপও বেড়েছে।

বুধবার (১২ মে) গাজীপুরের চন্দ্রা, ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের আশুলিয়া, ঢাকার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী, কাঁচপুর, শিমরাইল মোড়, গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে একটু দূরে আমিনবাজার থেকে কৌশলে কিছু বাস যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে রওনা দেয়। বুধবার রাতেও বিক্ষিপ্তভাবে ঢাকা থেকে কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষীপুরের উদ্দেশ্যে কিছু বাস ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকরা মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস চলতে দেখেছেন। যদিও কাউন্টার থেকে এসব বাসের টিকিট বিক্রি করা হয়নি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বুধবার রাতে ঢাকা পোস্টকে বলেন, শপিংমলসহ সবকিছু খোলা থাকলেও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি দূরপাল্লার বাস চালু করার জন্য। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। আমরা যদি সরকারের কাছ থেকে ঈদের পর দূরপাল্লার বাস চালানোর বিষয়ে কোনো আশ্বাস না পাই তাহলে নিয়ম মাফিক আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করব। 

তিনি বলেন, আমরা গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দূরপাল্লার বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এই দাবি মানা না হলে ঈদের দিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা অবধি দেশের সব বাস টার্মিনালে অবস্থান কর্মসূচি পালন করব।

ওসমান আলী বলেন, আমাদের ফেডারেশনের অধীন ২৪৯টি পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন এ কর্মসূচি পালন করবে। এজন্য সাংগঠনিকভাবে আমরা প্রস্তুতিও নিচ্ছি। আমি বিভিন্ন জেলায় পরিবহন নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কারণ দূরপাল্লার বাস চালাতে না পেরে পরিবহন শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের জন্য সরকারি সহায়তাও দেওয়া হয়নি। প্রায় ৫০ লাখ পরিবহন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। এবার তাদের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। পরিবহন শ্রমিকরা কেউ তাই পেটের দায়ে কোনো কোনো স্থানে বাস চালাচ্ছে ‍ভয় নিয়েই।

সরকার জেলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চালানোর অনুমতি দিয়েছে। তবে দূরপাল্লার বাস বন্ধ রাখার নির্দেশনা বহাল রেখেছে। এ অবস্থায়  ঈদুল ফিতরে বাড়ি যেতে যাত্রীরা বিকল্প পরিবহন যেমন- পণ্য পরিবহনের ভারী যানবাহন, ট্রাক, পিকআপ ছাড়াও অ্যাম্বুলেন্সে করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। আইনজীবী, চিকিৎসক ও জরুরি সেবার কাজে চলাচলকারী যানবাহনেও তারা চেপে বসছেন। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ভাড়া করেও ছুটছেন অনেকে।

বুধবার সকালে আমিনবাজার থেকে বাস না পেয়ে শত-শত যাত্রী ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন ছোট পরিবহন ব্যবহার করে সামনের দিকে যেতে থাকেন। বাহন না পেয়ে হেঁটে সামনে যেতে থাকা বৃদ্ধ সবুজ আলী বলেন, খুলনা শহরে যাবে। কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। কড়া রোদে ঘেমে হাতে ব্যাগ নিয়ে তিনি ছুটছিলেন গাড়ির আশায়।

বিভিন্ন পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার মহাখালী, গোলাপবাগ, কাঁচপুর, উত্তরা, গাজীপুরের চন্দ্রা ছাড়াও আশুলিয়া, বাইপাইলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বাসচালকরা চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছেন। চন্দ্রা থেকে কুড়িগ্রাম যেতে মারিয়া পরিবহনের একাধিক বাস ছেড়ে যায় বুধবার। এক্ষেত্রে বাসে সব মিলিয়ে ভাড়া আদায় করা হয় ৩৮ হাজার টাকা। এভাবে বাস ভাড়া করে যাত্রীরা রওনা দেন রাজশাহী, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, বগুড়াসহ বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। 

ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক হাসনাত নাঈম মঙ্গলবার রাত ১২টায় রওনা দিয়ে নিজস্ব পরিবহনে বুধবার সকাল সাড়ে আটটায় জামালপুর শহরে পৌঁছান। চলাচলকালে তিনি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা মোড়ে বুধবার ভোর সাড়ে ৫টায় দেখতে পান, ঢাকা থেকে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস ওই এলাকা অতিক্রম করছে। এছাড়াও ঢাকা থেকে ধনবাড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বিনিময় পরিবহনেও যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে রাতে ট্রাকের সারি ও সেই সঙ্গে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলার দৃশ্যও তিনি দেখতে পান। 

মহাসড়কে কিছু বাস কৌশলে চলাচল করলেও পুলিশের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়নি। বুধবার সকালে চন্দ্রা মোড়ে দায়িত্বরত মহাসড়ক পুলিশের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাধা দিয়ে লাভ নেই। 

মঙ্গলবার বিকেল থেকে দূরপাল্লার কিছু বাস গাজীপুর থেকেও ছেড়েছে উত্তরের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর বাড়ি গাজীপুরে। তিনি বলেন, এগুলো বিচ্ছিন্নভাবে চলছে যাত্রীর চাপে। কোনো বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে না বলে তিনি দাবি করেন।

বুধবার সকালে রাজধানীর প্রবেশপথ কাঁচপুর থেকে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষীপুরে যেতে কয়েকটি বাসে যাত্রী তোলা হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক সৈয়দ রায়হান। তিনি নিজস্ব পরিবহনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের দিকে যাওয়ার পথে এ দৃশ্য দেখেন। এছাড়া ভৈরবমুখী কয়েকটি বাস চলতেও দেখেন তিনি। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে ঈশিতা পরিবহনের বাসে যাত্রী তোলা হচ্ছিল। খোকন পরিবহনের বাসে ভৈরব যেতে যাত্রীদের ডাকা হচ্ছিল।

তবে বিকেল ৩টায় প্রাইভেট কার ভাড়া করে ঢাকা থেকে ফেনীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক আদিত্য রিমন মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস চলতে দেখেননি। তবে সন্ধ্যার পর ফেনী-লক্ষীপুর রুটে বাস চলতে দেখেছেন। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে দূরপাল্লার বাস চলতে দেখিনি। তবে লোকাল বাস চলছিল। 

এদিকে রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সেন্টমার্টিন পরিবহনের বাস চলতে দেখা গেছে। এছাড়া ঢাকা-লক্ষীপুর, ঢাকা-নোয়াখালী রুটের বাসও চলাচল করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যাত্রীদের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে ভ্রাম্যমাণ দালালরাও। যাত্রীদের বাসে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে দ্বিগুণের বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যেতে কাউন্টার থেকে টিকিট পাননি যাত্রীরা। রাজধানীতে বেশিরভাগ টিকিট কাউন্টার বন্ধই রাখা হয়েছিল। গাবতলী, কল্যাণপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাস কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করা না হলেও ভ্রাম্যমাণ দালালরা আগে টাকা নিয়ে পরে বাসে তোলার ব্যবস্থা করছেন গত কয়েকদিন ধরে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী যাত্রী আজিম উদ্দিন বলেন, কোথাও টিকিট না পেয়ে আসাদ নামে একজনের কাছে রাজশাহী যেতে ১২০০ টাকা দিয়েছি গাবতলিতে। বৃহস্পতিবার কোনো বাসে তুলে দিবে বলেছে। বিশ্বাস রেখে টাকা দিয়েছি। দেখি কি হয়।

আমিন বাজার, সাভার, হেমায়েতপুর থেকে ‘জরুরি সেবা’ ব্যানার লাগিয়ে লোকাল বাসে বিভিন্ন জেলার যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলছেন, লুকোচুরি করে কিছু বাস হয়ত চলছে। আমরা ঢাকার কোনো টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়ছি না।

পিএসডি/এসএসএইচ