পবিত্র ঈদুল ফিতর আজ। একমাস সিয়াম সাধনার পর সীমিত পরিসরে ঈদ আনন্দে মেতেছে মুসলিম সম্প্রদায়। তবে এবার ঈদের সেই চিরচেনা আনন্দের রূপে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট এবং অনিশ্চয়তায় অপরিচিত এক ঈদ উদযাপন করছে বাংলাদেশ। অনেকেরই করোনা মহামারিতে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনকে হারিয়ে ম্লান হয়ে গেছে এবারের ঈদের আনন্দ।

অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক। প্রাণঘাতী করোনা কেড়ে নিয়েছে তার বাবা মমিনুল হকের প্রাণ। ঈদে প্রতিটি মানুষ যখন বাবা মায়ের কাছেই ঈদের আনন্দ খুঁজেন, তখন তিনি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঈদ আনন্দ খুঁজে বেড়ান।

এবারের ঈদ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদককে তিনি জানান, সকালে ঈদের নামাজ আদায় করেই তিনটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন তিনি। সেখানে রোগীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। খোঁজখবর নেন ঈদে ছুটি না পাওয়া চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের।

খুরশীদ আলম বলেন, ‘এবারের ঈদটা আমাদের একটু ব্যতিক্রম হয়েছে। আপনারা জানেন গতবছর করোনাতে আমার বাবা মারা গিয়েছেন। তখন মায়ের অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেখান থেকে তিনি ফিরে এসেছেন। আমার বাবা-মায়ের মধ্যে এখন শুধু উনিই জীবিত আছেন। রাজধানীর রামপুরা এলাকায় আমাদের আদি বাড়ি, আমার দাদা করে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি আছেন।’

‘মৃত্যু তো সবারই আছে। প্রত্যেককে কোনো না কোনো সময় চলে যেতে হবে। কিন্তু করোনার কারণে শুধু বাবাই নন, একসঙ্গে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক,’ যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘ধানমন্ডির বাসার পাশে একটি ছোট মসজিদে অল্প কিছু লোক মিলে ঈদের নামাজ আদায় করেছি। নামাজ শেষে তিনটা হাসপাতাল ঘুরেছি, শুরুতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছি। সেখানে কোভিড, নন-কোভিড দুটোতেই ঘুরলাম। রোগীদের সঙ্গে কথা বলেছি, চিকিৎসক নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। তারপর সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে…। সেখানেও কোভিড, নন-কোভিড ও ইমার্জেন্সিতে গেলাম। তারপর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গিয়েছি, সেখানে শুধু কোভিড ইউনিটে গিয়েছি এবং সেখানকার ডাক্তার-রোগীদের সঙ্গে কথা বলছি। সেখানে তাদের খাবারের অবস্থা দেখলাম। চিকিৎসক-রোগীদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে এখন বাসায় যাচ্ছি।’

স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, ‘করোনার কারণে এবার ঈদে ডাক্তার-নার্সসহ কোনো স্বাস্থ্যকর্মীরই ছুটি হয়নি। বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন সবাইকে দূরে রেখে রোগীদের সঙ্গেই তারা ঈদ করছেন। সবাই যেখানে ঈদ করছে বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীরা ঈদের আনন্দ খুঁজছে রোগীদের সেবার মধ্যে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন, আমরা যেন আবার মাস্ক ছাড়া একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা করতে পারি, কথা বলতে পারি। আগামী ঈদ যেন আমরা আমাদের পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারি। তাদের নিয়ে ঘুরতে পারি, আনন্দ করতে পারি, করোনা মহামারি যেন এই সময়ের মধ্যে বিদায় নিয়ে নেয়।’

স্বাস্থ্য মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘করোনার সময়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার অনেক মানুষ মারা গেছেন। এ পর্যন্ত করোনায় আমরা এতসব গুণী মানুষকে হারিয়েছি, যা কখনও ভোলার মতো নয়। আমাদের অসংখ্য ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন, বিশেষ করে এ সময়টাতে অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মারা গেছেন। যা আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সেজন্য আমরা অত্যন্ত শোকাহত।’

শুধু অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলমই নন। তার মতো অনেকেই পরিবার আত্মীয় স্বজনকে হারিয়েছেন, যাদের অনেকটা সাদামাটই কাটছে ঈদের দিন।

ঈদের দিন সকালে নামাজের পর একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করা, বড়দের সালাম করে সালামি নেওয়া, প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করা, ঘুরে বেড়ানো এগুলোই হচ্ছে ঈদের আনন্দ। তবে এবারে ঈদের সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। ফলে ঈদে নেই সেই চিরাচরিত আনন্দের আবহ। অনেকেই বাড়ি-ঘর, পরিবার-পরিজন, বাবা-মার কাছ থেকে দূরে থেকে ঈদ উদযাপন করছেন। ঈদের সার্বজনীন চরিত্র হারানোর এ অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে নতুন। ভয় অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কে ঈদের আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।

একনজরে খুরশীদ আলম
অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনার মাইজখার ইউনিয়নের পানিপাড়া গ্রামে হলেও তিনি নগরীর ঝাউতলা এলাকায় স্থায়ীভোবে বসবাস করছেন। তার জন্ম ১৯৬১ সালের ৩১ ডিসেম্বর।

ব্যক্তিগত জীবনে খুরশীদ আলম দুই ছেলে সন্তানের জনক। এক ছেলে পেশায় চিকিৎসক এবং অন্য ছেলে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। খুরশীদ আলমের স্ত্রী ডা. ফাতেমা রহমান পিংকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস করে ১০ম বিসিএসের মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের ২২ নভেম্বর ইন-সার্ভিস ট্রেনিংয়ের আওতায় সহকারী সার্জন হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালের ৪ অক্টোবর মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী সার্জন হিসেবে যোগদান করেন। পরে মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন সাব সেন্টার ও কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়াও ডা. খুরশীদ আলম সহকারী সার্জন হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার, জুনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সিনিয়র কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন।

সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক হিসেবে ২০১৮ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সদস্য।

অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও রয়েছে অবাধ বিচরণ। তিনি বাংলাদেশ বেতারের একজন তালিকাভুক্ত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। এছাড়াও তিনি জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ কুমিল্লা শাখার প্রশিক্ষক ছিলেন। পরে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।

টিআই/এসএম