করোনায় গত দেড় বছরে নারী পুরুষে বৈষম্য আরও বেড়েছে। বিগত সময়ের অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিয়েছে। করোনা মহামারি  নারীর জীবনে সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলেছে। আয়-ব্যয়ে নারী প্রধান পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। শিক্ষায় ঝড়ে পড়া, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, নারী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের নেতিবাচক দিক লক্ষণীয়। আসন্ন বাজেটে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, অনানুষ্ঠানিক খাতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ‘নারীর উপর কোভিড- ১৯ এর প্রভাব এবং আসন্ন জাতীয় বাজেট’ বিষয়ক অনলাইন আলোচনা সভা। রোববার (২৩ মে) বেলা ১১টায় শুরু হওয়া সভায় এসব কথা বলেন আলোচকরা।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম সভায় সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা।

সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরমিন্দ নিলোর্মী, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ ও ডিবিসি চ্যানেলের বার্তা বিভাগের প্রধান প্রণব সাহা।

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, গত দেড় বছরে কোভিড পরিস্থিতি নারী ও পুরুষের বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিগত সময়ের অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। চলমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নারীর অবস্থার উন্নয়নের জন্য ও উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে ধরে রাখতে বাজেটে বিশেষভাবে সরকারের মনোযোগ দেওয়া দরকার।

নারীর ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব বিষয়ক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, মহামারিতে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। সানেমের ২০২০-২০২১ সালে করা বিভিন্ন জরিপের ফলাফল অনুসারে শ্রমবাজার, স্বাস্থ্য, শিক্ষায়, জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতায় নারীদের অবস্থান বিশ্লেষণ করেছে। 

দেখা গেছে, শ্রমবাজারে নারীরা বেশি কাজ হারিয়েছে। নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ। আয়-ব্যয়ে নারী প্রধান পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। শিক্ষায় ঝড়ে পড়ার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। অনলাইন ক্লাস ইতিবাচক হয়েছে তা বলা যাবে না। স্বাস্থ্যে অতিরিক্ত খরচ নারীদের বেলায় বেশি হয়েছে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নেতিবাচক দিক লক্ষ্য করা যায়।  

নারীর প্রতি সহিংসতা ঘরে-বাইরে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি কোভিড থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন।

সায়মা হক বিদিশা বলেন, জেন্ডার বাজেট নিয়মিতভাবে তৈরি করতে হবে। ঝড়ে যাওয়া রোধে মিড-ডে মিল ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সেফটি নেট প্রোগ্রামের আওতায় নতুনভাবে দরিদ্রদের সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণ প্রাপ্তির হার বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়া, মূলধারার শ্রমবাজারে নিয়ে আসা ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে। 

তিনি বলেন, অভিবাসী নারীদের নিরাপদ ও সম্মানজনক কাজে অন্তর্ভুক্তি করা, তথ্য সহায়তা দেওয়া জেন্ডার ভিত্তিক ডিভাইস প্রদানে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, জেন্ডার ভিত্তিক তথ্য উপাত্তে জোর দিতে হবে। অস্বীকৃতিমূলক কাজকে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নে বাজেটে বরাদ্দ যেমন গুরুত্বপূর্ণ এর সঙ্গে তা নারীর জন্য কতটা কার্যকর হচ্ছে সেটিও মূল্যায়নে পরিবীক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।

সভায় উপস্থিত আলোচকরা বলেন, সমাজের রাষ্ট্রনীতিতে, অর্থনীতিতে নারী পুরুষের মাঝে থাকা বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে কোভিড মহামারির অভিঘাত। জেন্ডার বাজেটের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নে গৃহীত ক্ষেত্রগুলোতে যেমন নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে, সহিংসতা প্রতিরোধে উন্নতি তেমন হয়নি। অর্জন যতটুকু হয়েছে তা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আড়াই থেকে তিন কোটি।

সমস্যার সমাধানে বক্তারা বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচ বৃদ্ধি করতে পারলে চলমান বৈষম্য কমানো যাবে। এই খাতে বরাদ্দ বাড়লেও তা সন্তোষজনক নয়। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। বাজেটে অনানুষ্ঠানিক খাতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। স্টার্টআপের পাশাপাশি থোক বরাদ্দ চালু করতে হবে। নারী অভিবাসীরা যারা কাজে ফেরত যেতে চায় তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। 

তারা বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে নারী অভিবাসীদের সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে। নারী নির্ভর কর্মসূচির কলেবর বাড়াতে হবে, সামাজিক সুরক্ষা নীতিমালার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে মনিটরিং সেল গঠনে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে করতে হবে। বরাদ্দ কম-বেশির চেয়ে দেখা জরুরি বরাদ্দে নারীকে গুরুত্ব দেওয়া, গুণগত বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। নতুন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা কর মুক্ত রাখতে হবে। সঞ্চয়পত্রে নারীদের জন্য সুদের হার বৃদ্ধি করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ বন্ধে ক্ষমতার জায়গা নিয়ন্ত্রণ করতে  হবে।

আগামী বাজেটে নারীর কর্মসংস্থানে নীতিগত সহায়তা, মনোজগতে পরিবর্তন সহায়তা সবচেয়ে জরুরি। এর উত্তরণে জেন্ডার বাজেট সংক্রান্ত আলোচনায় মনস্তত্ববিদ, সমাজবিদদের উপস্থিতি জরুরি বলে মতামত দেন বক্তারা। 

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অর্থনীতিতে, নারীকে মূলধারায় নিয়ে আসার জায়গায় জোর দিতে হবে। সব অর্থনৈতিক কাজে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রকে সংবেদনশীল করে তোলা, নেতৃত্বে নারীকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। বাজেট প্রণয়নে যারা যুক্ত তাদের জেন্ডার সেনসিটিভ মনোভাব গড়ে তোলার মাধ্যমে জেন্ডারবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলতে জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।

জেইউ/ওএফ