জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ১৬ মে মিরপুরের পল্লবীতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাহিনুদ্দিন নামে এক যুবককে। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে লক্ষ্মীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়ালের নাম এসেছে। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া দু’জন ইতোমধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। 

সাহিনুদ্দীনকে এর আগেও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এ দফায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে কৌশলে ত্রিমুখী বিরোধের মুখে ফেলা হয় তাকে। সমঝোতায় আসতে চাইলেও বিরোধীপক্ষ সাবেক সেনা কর্মকর্তা মোস্তফা কামালের পক্ষ নেওয়া ও ক্যাডার সুমনের সাথে বৈরিতায় সাহিনুদ্দীনকে বিশ্বাস করেননি আউয়াল। পাল্টাপাল্টি চার মামলায় জেল খেঁটে বেরিয়ে এক সপ্তাহ না যেতেই খুন হতে হয় তাকে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর কলাবাগানে সুলতানা টাওয়ারের তৃতীয় তলায় আউয়ালের অফিস। সেখানে বসেই সাহিনুদ্দীন খুনের নীল নকশা করা হয়। তিনি দায়িত্ব দেন নিজস্ব ক্যাডার, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুমন বেপারীকে।

 র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার আউয়াল

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর সাহিনুদ্দীন খুনের ঘটনায় রোববার পর্যন্ত সাবেক এমপি আউয়ালসহ গ্রেফতার হয়েছেন ১০ জন। তাদের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। শনিবার ডিবির অভিযানে গ্রেফতার তিন আসামি শরীফ, টিটো ও ইকবালকে রোববার চার দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর হাকিম ধীমান চন্দ্র মণ্ডলের আদালত। আউয়ালসহ সাত গ্রেফতার আসামির ডিবি পুলিশের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

এ ব্যাপারে রোববার দুপুরে অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে ডিএমপির গোয়েন্দা উত্তর বিভাগের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, সাহিনুদ্দীন হত্যা যে পরিকল্পিত গ্রেফতার হওয়ারা জিজ্ঞাসাবাদে তা স্বীকার করেছেন। তিনজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। এই ঘটনা তদন্তকালেই আমরা মিরপুরে জমি সংক্রান্ত আরও বেশ কিছু বিরোধ-দ্বন্দ্ব মারামারিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ পাচ্ছি। সব কিছু আমলে নিয়ে ডিবি পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।

সাহিনুদ্দীন খুনে আসছে আরও অনেকের নাম
গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে সাহিনুদ্দীন হত্যার নেপথ্যে ও সাবেক এমপি আউয়ালের নানা অপকর্মের সাথে অনেকের সংশ্লিষ্টতার তথ্য উঠে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে পল্লবীতে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ঝুটের নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল বাণিজ্যে জড়িত একটি বড় চক্র। এই চক্রকে পেছন থেকে স্থানীয় এক কাউন্সিলর সহায়তা করেন বলেও সন্দেহ করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। 

নিহত সাহিনুদ্দীনের পরিবারের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরে হ্যাভেলি কোম্পানির সঙ্গে তাদের বিরোধ চলছিল। একাধিকবার মামলা-হামলা চালিয়েও সাহিনুদ্দীনকে বাগে আনতে না পেরে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়ায় আউয়ালের লোকজন। তবে হ্যাভেলির সঙ্গে সমঝোতা করলেও জমির দখল না ছাড়ায় খুন করা হয় সাহিনুদ্দীনকে।

সাহিনুদ্দীন হত্যায় পরিকল্পনাকারী আউয়াল হলেও এতে সরাসরি কাজ করেছেন ক্যাডার সুমন। নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন স্থানীয় ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলর। একই চক্রে স্থানীয় বিহারি আড্ডু সোহাগ ও মাসুদ নামে আরও তিনজন জড়িত।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সাহিনুদ্দীন খুন ও সাবেক এমপি এমএ আউয়ালের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত আরও অনেকের নাম এসেছে। স্থানীয় কমিশনার, বিহারী নেতাসহ রাজনীতিক, ক্যাডার বাহিনীর দৌরাত্ম্যে সরকারি-ব্যক্তি মালিকানার জমি দখলের মহোৎসব চলছিল। পল্লবী বুড়িরটেক এলাকার জমি দখলে বাধা ছিল সাহিনুদ্দীন। সেজন্য তাকে হত্যা করা হয়। 

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এ হত্যাকাণ্ডে যাদের নাম আসছে তাদের ভূমিকা আমরা খতিয়ে দেখছি। তাদের অপকর্মের তথ্য পেতে তাদের কথোপকথনের সিডিআর ও মামলা সংক্রান্ত তথ্য তদন্ত করা হচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন আউয়াল-সুমন
র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর ডিবি পুলিশের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে সাবেক এমপি আউয়ালের। প্রযুক্তিগত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদে সাহিনুদ্দীন হত্যার পরিকল্পনা ও নিজের সম্পৃক্ততা বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি আউয়াল। তবে খুনে জড়িত নন বলে দাবি করলেও খুনের দায় কোনোভাবে এড়াতে পারেন না তিনি।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার সুমনের দাবি, আলীনগরে আউয়ালের প্রকল্প এগিয়ে নিতে বাধা ছিল সাহিনুদ্দীন পরিবার। সাহিনুদ্দীনকে সরিয়ে দিতে আউয়ালকে প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি রাজি হন। এজন্য ২০ বা ৩০ লাখ টাকা যা লাগে তা দিতেও তিনি রাজি হন। অফার পেয়ে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করতে বাইরে থেকে চারজন খুনিকে ভাড়া করে সুমন।

দুইবার বেঁচে গেলেও তৃতীয় দফায় খুন সাহিনুদ্দীন
বিরোধের জেরে গত বছর আউয়াল তার নিজস্ব ক্যাডার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুমন বেপারীকে দিয়ে সাহিনুদ্দীনকে হত্যার চেষ্টা করেন। সেবার প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তবে হ্যাভেলি প্রকল্পের কাজে বাধা, ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি এবং সাইনবোর্ড ভাঙার অভিযোগে আউয়ালের মামলায় সাহিনুদ্দীন ও তার ভাই মাইনুদ্দীন জেল খাটেন। জেল থেকে বের হয়ে সুমনের নির্মাণকাজে বাধা ও দেওয়াল ভাঙার অভিযোগে সুমনের সঙ্গে বিরোধ আরও বাড়ে। হত্যার এক সপ্তাহ আগে সুমন বাহিনী সাহিনুদ্দিনকে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। তবে এলাকাবাসীর বাধায় দ্বিতীয় দফাতেও বেঁচে যান সাহিনুদ্দীন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দু’জনকে গ্রেফতার করলেও পালিয়ে যায় সুমন। 

সর্বশেষ গত ১৬ মে বিকেলে ৫ বছরের ছেলেকে মোটরসাইকেলে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে খুন হন সাহিনুদ্দীন।

সাহিনুদ্দীন হত্যার পর জড়িত দুজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত
সাহিনুদ্দীন হত্যার ঘটনায় একটি ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারের পর ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়ায়। ওই ভিডিও’তে যে দু’জন যুবককে নৃশংসভাবে সাহিনুদ্দীনকে কুপিয়ে হত্যা করতে দেখা যায় তারা হলেন, মানিক ও মনির। গত শুক্রবার ভোরে রূপনগর এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন এ মামলার আরেক আসামি মো. মানিক। আর গত শনিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে পল্লবীর সাগুফতা হাউজিং এলাকায় গোলাগুলির ঘটনায় মনির নিহত হয় বলে ডিবি পুলিশ দাবি করে। 

উল্লেখ্য, গত ১৬ মে বিকেলে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৩১ নম্বর সড়কে সাহিনুদ্দিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় তার মা আকলিমা বেগম ২০ জনকে আসামি করে পল্লবী থানায় মামলা করেন।

নিহতের পরিবারের অভিযোগ, সাহিনুদ্দিনের পরিবারের ১২ একর জমির দখল নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন সাবেক এমপি আউয়াল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। জমি দখল করতে পরিকল্পিতভাবে তাকে খুন করা হয়।

জেইউ/এনএফ