রাজধানীর দক্ষিণখান সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমামের কাছে কোনো না কোনো কিছুর জন্য নিয়মিত যাওয়া আসা ছিল গার্মেন্টস কর্মী আজহারুলের স্ত্রী আসমা বেগমের। কখনো তাবিজ আবার কখনো পানিপড়া আনতে যেতেন তিনি। এই যাওয়া আসার মধ্যেই একপর্যায়ে ইমামের সঙ্গে সম্পর্ক হয় আসমার। আসমা ও ইমামের এই সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারেন স্বামী আজহারুল। এটিই কাল হলো আজহারুলের জন্য। তাকে হতে হলো সাত টুকরো।

দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি এলাকার বাসিন্দা এবং ওই জামে মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়া মুসল্লিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। মো. এরশাদ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমানের বয়স ৬৫। তিনি গত ৩০ বছর ধরে এই মসজিদে ইমামতি করছেন। আজহারুলের ছেলে গত কয়েকবছর ধরে এই ইমামের কাছে কোরআন পড়া শিখত। ছেলেকে মসজিদ থেকে আনা নেওয়া করতেন আজহারুলের স্ত্রী আসমা। এ সময় আসমা বেগমের সঙ্গে ইমামের দেখা ও কথা হতো। একপর্যায়ে ইমামের কাছে ছেলের জন্য পানিপড়া, রোগমুক্তির তাবিজ আনার কথা বলে নিয়মিত যেতেন আসমা। কোরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইমামও তাদের বাসায় যেতেন।

আজহারুল ও তার স্ত্রী আসমা বেগম

আজহারুলের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বছর ধরে তার স্ত্রীর সঙ্গে ইমামের পরকীয়ার সম্পর্ক চলছিল। আজহারুল বিষয়টি টের পেয়েছিলেন। এ জন্য পাঁচ মাস আগে আজহারুল বাসা পরিবর্তন করে দক্ষিণখানের মধুবাগ এলাকার হাজি মার্কেটের সামনে চলে যান। এতেও চিড় ধরেনি আসমা-ইমামের সম্পর্কে। নিয়মিত দেখা হতো তাদের। ১৫-২০ দিন আগে তাদের ছেলে আসমা ও ইমাম আব্দুর রহমানকে মসজিদে একসঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে দেখতে পায় বলে তার বাবা আজহারুলকে জানিয়ে দেয়।

পুলিশ জানায়, ছেলের কাছ থেকে মায়ের অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি শুনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাননি আজহারুল। বরং স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তার নিজ বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে চলে যান। কালিহাতী থেকে ইমামকে ফোন করেন আজহারুল। ফোনে তিনি ইমামকে বলেন, ‘হুজুর আপনাকে আমি বিশ্বাস করতাম। আপনি কীভাবে আমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক করলেন?’ জবাবে ইমাম বলেন, ‘তুমি যা ভাবছ ঘটনা তা না, তুমি ঢাকায় আসো আমি তোমাকে সব ঘটনা খুলে বলি’।

স্ত্রীর হুজুর প্রেমিকের কাছে ‘ঘটনা’ জানতে ২০ মে (বৃহস্পতিবার) দক্ষিণখানের সরদার বাড়ির মসজিদে গিয়েছিলেন আজহারুল। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। নিখোঁজের পাঁচ দিন পর মঙ্গলবার (২৫ মে) দক্ষিণখানের ওই মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে তার সাত টুকরো মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এই বাসাটিতেই স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে থাকতেন আজহারুল

এ ঘটনায় ‘জড়িত’ রয়েছেন এমন সন্দেহে ইমাম আব্দুর রহমানকে আটক করেছে দক্ষিণখান থানা পুলিশ। জানতে চাইলে পুলিশের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, আসমা ও ইমাম আব্দুর রহমান তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন। বৃহস্পতিবার আজহারুল মসজিদে এলে সুযোগ পেয়ে ইমাম তাকে হত্যার পর টুকরো করে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে ঢুকিয়ে রাখেন।’

স্থানীয়রা বলছেন, হুজুরের বয়স ৬৫। তার একার পক্ষে আজহারুলকে সাত টুকরো করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে এমনও হতে পারে তিনি আজহারুলকে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অজ্ঞান করে হত্যার পর টুকরো করেছেন।

এ বিষয়ে দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ ঘটনায় পরকীয়ার বিষয়ে অনেক কিছুই শুনেছি। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু বলতে পারব না। আসামি র‍্যাবের কাছে আছে। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’

নিহত আজহারুলের আগের বাসার প্রতিবেশী রাশিদা বলেন, ‘আজহারুল খুব ভালো মানুষ ছিল। দেখা হলেই সালাম দিতেন। খুবই শান্ত মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গে কখনো খারাপ আচরণ করতেন না। তাকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমরা তার হত্যাকারীর বিচার চাই।’

মসজিদের সেই সেপটিক ট্যাংক

আজহারুলের মধুবাগ বাসার প্রতিবেশী শামসুর রহমান ইশা বলেন, ‘তারা বাসায় পাঁচ মাস আগে ওঠেন। মাঝেমধ্যে দেখতাম, হুজুর বাসায় আসতেন এবং ভিকটিমকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। স্বামী-স্ত্রীর (আসমা-আজহারুল) মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তাদের মধ্যে তেমন ঝগড়া হতো না। হুজুর তাদের বাসার সবাইকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। আজহারুল ঈদের আগের দিন পরিবার নিয়ে বাড়ি চলে যান। পরে পরিবারের লোকজনকে বাড়ি রেখে ১৯ মে (বুধবার) ঢাকায় আসেন। এর পরদিন অফিস শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আবার বের হন। এরপর আরে ফিরে আসেননি।’

ঘটনাস্থলের চিত্র

মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাস্থলে সরেজমিনে দেখা যায়, টুকরো করা মরদেহ উদ্ধারের স্থানটি ঘিরে রেখেছে উৎসুক জনতা। মসজিদের সেপটিক ট্যাংকের কাছে যেতেই গলিত মরদেহের দুর্গন্ধ নাকে আসছিল। মসজিদটির প্রবেশপথের একদম সামনেই সেপটিক ট্যাংকের ঢাকনাটি ভেঙে মরদেহের টুকরোগুলো উদ্ধার করে র‍্যাব। ট্যাংকে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, মানুষের শরীরের চর্বি ভাসছে এবং পানিতে বিভিন্ন পোকামাকড়।

নাকে কাপড় দিয়ে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন এবং দেখছেন। মসজিদ ভবনটি এখনো নির্মাণাধীন। মসজিদের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হলেও সেপটিক ট্যাংকসহ আরও বেশ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ধারণা করছেন, সেপটিক ট্যাংকটির কাজ শেষ না হওয়াতে হত্যাকারী মরদেহের টুকরোগুলো এখানে ফেলে ঢালাই করে দিয়েছে যাতে কেউ মরদেহ খুঁজে না পায়।

এমএসি/এআর/এফআর