এক বছর ধরে মেয়ের কোনো খবর নেই। নেই যোগাযোগও। ভেবেছিলাম চাঁদপুরে শ্বশুর বাড়িতেই আছে আমার বড় মেয়ে। কিন্তু গতকাল ভিডিও দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি, এটি আমার মেয়ে। আমার মেয়ের সঙ্গে যা হয়েছে, তা যেন আর কারো সঙ্গে না হয়। আমি এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাই.. বলছিলেন ভারতে যৌন নির্যাতনের শিকার তরুণীর বাবা।

সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি ওই তরুণী যৌন নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভিডিওটি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারতে চাঞ্চল্য তৈরি করে। নির্যাতনের ভিডিও নজরে এলে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে ঘটনার তদন্ত শুরু করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ।

বৃহস্পতিবার (২৭ মে) রাতে হাতিরঝিল থানায় গিয়ে ভিডিও দেখে নিজের মেয়েকে শনাক্ত করেন তরুণীর বাবা। পুলিশের সহযোগিতায় মানবপাচার প্রতিরোধ দমন আইন ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন তিনি।

মামলার এজাহারে তরুণীর বাবা জানান, তিনি মগবাজার এলাকার ফুটপাতে ব্যবসা করেন। ছয়-সাত বছর আগে তার মেয়ের বিয়ে হয়। মেয়ের জামাই তিন বছর ধরে কুয়েতে থাকেন। স্বামী বিদেশ যাওয়ার পর থেকে মেয়ে বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি উভয় জায়গায় থাকতেন।

১৫ মাস আগে তরুণী বাবাকে জানান, তিনি দুবাই যাবেন। বাবা তাকে নিষেধ করেন। তবে এক বছর ধরে মেয়ে নিখোঁজ। পরে তিনি জানতে পারেন, মগবাজারের রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয় তাকে ফুসলিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে পাচার করে। কিছুদিন আগে তিনি জানতে পারেন মেয়ে হৃদয়ের সঙ্গে ভারতে আছেন। তবে সম্প্রতি ভিডিও দেখে তিনি তার মেয়েকে চিনতে পারেন। ভিডিওতে রিফাদুলকে দেখা গেছে, সে তার মেয়েকে নিয়ে গেছে।

শুক্রবার (২৮ মে) দুপুরে রাজধানীর মগবাজারে গিয়ে সেই ভুক্তভোগী তরুণীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জামাই কুয়েত যাবার পর থেকে আমার মেয়েকে চাঁদপুরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন নির্যাতন করতেন। এ কারণে মেয়ে মগবাজারে আমার বাসায় প্রায়ই আসা-যাওয়া করত।

তিনি বলেন, প্রায় ১৫ মাস আগে মেয়ে জানায়, মগবাজারে বন্ধু হৃদয়ের সঙ্গে সে দুবাই যাবে। আমি নিষেধ করেছিলাম। এ বিষয়ে কুয়েত প্রবাসী জামাইয়ের সঙ্গে তাকে কথাও বলতে বলি। পরিস্থিতি বুঝে তিন বছরের নাতনীকে আমার কাছে নিয়ে আসি। কিন্তু এর কয়েকমাস পরই নিখোঁজ হয় আমার বড় মেয়ে। মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় খোঁজ নিয়েও ওর সন্ধান পাইনি। ভেবেছিলাম শ্বশুরবাড়িতেই আছে। কিন্তু আমার মেয়েকে পাচারের উদ্দেশ্যে ভারতে নিয়ে এভাবে নির্যাতন ও সম্মানহানি করা হবে ভাবিনি।

ভারতে নির্যাতনের শিকার তরুণীর বাবা বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। একদিন কাজ না করলে পেটে খাবার জোটে না। তাই হয়তো চাঁদপুরে গিয়ে খোঁজ নিতে পারিনি। কিন্তু যে বা যারা আমার মেয়েকে পাচার করতে চাইল, নির্যাতন করল, সম্মানহানি করল, তাদের বিচার চাই। তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, যাতে আর কেউ এমন অপকর্ম করতে সাহস না পায়।
ভারতে গ্রেফতার নির্যাতনকারীরা 

ভারতে নির্যাতনের শিকার তরুণীর ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণীকে বিবস্ত্র করে কয়েকজন তরুণ নির্যাতন করছেন। এ বিষয়ে ভারতের বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশের এক প্রেস নোটে জানানো হয়, ভিডিও ক্লিপ দেখে ঘটনায় জড়িত এক নারীসহ পাঁচজনকে দ্রুত শনাক্ত করে আটক করা হয়েছে। এরপর ভিডিও ক্লিপ এবং আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের ভিত্তিতে রামমূর্তি নগর থানায় তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নিপীড়ন ও এ সংশ্লিষ্ট আইনের অন্যান্য ধারায় মামলা করা হয়।

এ বিষয়ে দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, নির্যাতনকারী চক্রটি ওই তরুণীকে নির্যাতনের সময় ভিডিও ধারণ এবং এর ক্লিপ আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করে। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরপরই নর্থ ইস্ট পুলিশ ও বাংলাদেশ পুলিশ তদন্ত শুরু করে।

পরে ওই ঘটনায় বাংলাদেশেরই রিফাতুল ইসলাম হৃদয় (২৬) নামে এক যুবক জড়িত বলে সত্যতা পাওয়ার কথা জানায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ। অভিযুক্ত যুবক রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা।

ভারতে বাংলাদেশি তরুণীর নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিও সম্পর্কে শুক্রবার (২৮ মে) দুপুরে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে থাকা একজনের সঙ্গে বাংলাদেশি একটি ছেলের ছবির মিল রয়েছে। আমরা জেনেছি বেঙ্গালুরু পুলিশ জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগী ও জড়িত অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

জেইউ/আরএইচ/জেএস