প্রতীকী ছবি

টিকটক মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে সারাদেশে মানবপাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে মানবপাচার চক্রের সদস্যরা। দেশের প্রতিটি জেলা, থানা, এমনকি গ্রাম পর্যায়েও তাদের নিয়োজিত লোকজন রয়েছে। পাশাপাশি ভারতে পাচার করা নারীদের বিষয়েও নতুন তথ্য দিচ্ছে রিমান্ডে থাকা চক্রের সাত সদস্য।

গ্রেফতার চক্রের সদস্যরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, তারাই বিভিন্ন এলাকার নারীদের কৌশলে নানা প্রলোভনে ফাঁদে ফেলে ভারতে পাচার করে আসছিল।

নারী পাচার নিয়ন্ত্রণে গত পাঁচ দিনের অভিযানে গ্রেফতার হওয়া সাত জনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তারা বর্তমানে হাতিরঝিল থানা পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।

হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, নারী পাচারের ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা দুটি মামলার তদন্ত চলছে। দুই মামলায় গ্রেফতার সাত জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এসেছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারে জোর প্রচেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, চক্রটি শুধু মানবপাচারই করছে না, প্রলোভনের জাল বিস্তার করে প্রতারণা করছে চাকরি কিংবা মডেল হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণ-কিশোরীদের সঙ্গে। এই বার্তা সমাজের জন্য খারাপ। এই ধরনের প্রতারণা বন্ধে সব পর্যায়ের মানুষের সহযোগিতা ও সচেতনতা প্রয়োজন।

সারাদেশ থেকে টিকটকের আড়ালে এই চক্রের মাধ্যমে অসংখ্য মেয়ে এরই মধ্যে পাচার হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এই সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

দুই বোনকে মডেল বানানোর ফাঁদে ৩ লাখে ভারতে বিক্রি

ইতোপূর্বে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাচারের শিকার নারীদের সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে ময়মনসিংহের দুই বোনের পাচার হওয়ার ঘটনা তদন্ত পর্যায়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

টিকটকের আড়ালে নারী পাচারের আলোচিত দুই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দুই বছর আগে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার দরিদ্র পরিবারের দুই তরুণী চাকরি নেয় শ্রীপুর উপজেলার জৈনা বাজার এলাকার একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে। পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করত তারা। সেখানেই টিকটক চক্রের নারী পাচারকারী চক্রের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে তাদের। চক্রের সদস্য সুজন নেত্রকোনার ও অপরজন ইউসুফ ময়মনসিংহের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য পাশাপাশি বসবাস, দেখা-সাক্ষাত শুরু করে। একপর্যায়ে বড় বোনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে ইউসুফ। মাসে ৫০ হাজার টাকা আয়ের লোভ দেখিয়ে তারা দুই তরুণীকে নিয়ে টিকটক ভিডিও বানায়। এরপর জীবননগর সীমান্ত দিয়ে ভারতের রানাঘাট এলাকায় নিয়ে দুই বোনকে তিন লাখ টাকায় নারী কারবারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

ওই কর্মকর্তা জানান, পশ্চিমবঙ্গের দিঘা এলাকার বিভিন্ন বাসায় ও হোটেলে রেখে তাদের দিয়ে দেহ ব্যবসা চালানো হচ্ছিল। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবে গত ১৬ মে লকডাউন শুরু হওয়ার পর পাচারকারীদের নজরদারি এড়িয়ে দুই বোন পালিয়ে যায়। শিয়ালদহ এলাকায় ভারত সরকার পরিচালিত সেফ হোম পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠানে এক বোন, আরেক বোন রয়েছে ভারতের বোঝাপড়া সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ’র সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের কাছে। তারা এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

ঠিক একইভাবে ভারতে পাচার হওয়া তরুণী দুই মাসের অমানুষিক নির্যাতনের পর গত ৭ মে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি মঙ্গলবার (১ জুন) হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।

মামলার পর পুলিশ জানিয়েছিল, ওই নারীকে পাচারে জড়িত ১২ জন। তাদের মধ্যে ভারতীয় সাত জন, দেশীয় পাঁচ জন। ওই পাঁচ জনের মধ্যে মেহেদি হাসান, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদের নামে তিন জনকে মঙ্গলবার (১ জুন) দিবাগত রাতে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও বিভাগ পুলিশ। এর মধ্যে দোষ স্বীকার করে মেহেদি হাসান পুলিশকে জানিয়েছে, ওই কিশোরীসহ প্রায় দেড় হাজারের বেশি নারীকে ভারতে পাচার করেছে তারা।

এ ব্যাপারে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, টিকটকের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এই পাচারকেন্দ্রীক অপচেষ্টারও শুরু। উঠতি বয়সী কিশোরী-তরুণীদের মডেল বা স্টার বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে পাচার করছে এই চক্র। পাচারের শিকার ও পাচারকারীরা অবৈধভাবে ভারতে যায়।

তিনি জানান, ভারতে পাচার হওয়া নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে মামলার তদন্তে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে।

এর আগে সোমবার (৩১ মে) টিকটকের মডেল বানানো ও উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভনে নারী পাচারকারী চক্রের অন্যতম মূলহোতা আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফিসহ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। হাতিরঝিল থানার মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

মঙ্গলবার (১ জুন) সন্ধ্যায় রাজশাহীতে টিকটিক ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছাড়ার প্রস্তুতির অপরাধে তিন তরুণীসহ আরও নয়জনকে গ্রেফতার করেছে আরএমপি গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ঘটনায় বেঙ্গালুরু পুলিশ ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে টিকটক হৃদয়সহ দুজন পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয় বলে জানিয়েছে ভারতের পুলিশ।

বাংলাদেশি ওই তরুণীকে যৌন নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ২৭ মে হাতিরঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী মেয়ের বাবা। প্রায় এক বছর ধরে নিখোঁজ থাকা মেয়েকে ভিডিও দেখে শনাক্তের পর মামলা দায়ের করেন তিনি।

জেইউ/এসএসএইচ