আগে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করতেন গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধন। ২০১৮ সাল থেকে ইন্টারনেটের ব্যবসায় নামেন তিনি। স্বদেশ কমিউনিকেশনস নামক ইন্টারনেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ততা ছিল সাধনের। স্থানীয়দের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় কখনো জড়াননি। সেই সাধনই রোববার (২৫ মে) রাতে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন।

প্রশ্ন উঠছে, সাধনকে খুন করলো কারা! রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় ওই হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা হতে চললেও এখনো কোনো সুরাহা করতে পারেনি পুলিশ। তবে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দুই যুবককে শনাক্ত করেছে। তাদের খুঁজে পেতে চলছে অভিযান।

নিহতের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন সকাল ১০/১১টার মধ্যে বাসা থেকে বের হতেন তিনি (কামরুল আহসান সাধন)। ফিরতেন রাত ১১/১২টার মধ্যে। কখনো কখনো আরো রাত করে ফিরতেন। 

‘গতকাল (রোববার) তিনি বাসায় ফেরেন রাত পৌনে ১০টায়। তখন আমি নামাজ আদায় করছিলাম। বললাম আর তিন রাকাত নামাজ বাকি। শেষ করে খাবার দিচ্ছি, খেয়ে যান। এর মধ্যে একটা কল আসে। ওই কলে কথা বলতে বলতে তিনি দরজা বাইরে থেকে লক করে বের হয়ে যান। ২০ মিনিট পরেই খবর আসে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি।’

দিলরুবা আক্তার বলেন, ‘লোকটার সঙ্গে আমার ২৪ বছরের সংসার। আমাদের কোনো সন্তান নেই। অত্যন্ত সুসম্পর্কেই সংসার করছিলাম। কখনোই আমাদের মধ্যে সম্পর্কে টানাপড়েন আসেনি। মহল্লায় বড় হওয়া সাধনের সঙ্গে কারো বিবাদ-বিরোধ ছিল না। ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক কারণেও কারো সঙ্গে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব ছিল বলে কখনো শুনিনি।’

দিলরুবা বলেন, ‘এমন একটা লোককে কেউ হত্যা করতে পারে! তারা কেমন পাষণ্ড! এখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো?’

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নিহত বিএনপি নেতা সাধনের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলা সদরে। বাবা-মা মারা গেছেন। সাধনের এক বোন। তিনি রাজধানীর উত্তরায় থাকেন। 

ব্যবসায়িক জীবনের শুরুতে তিনি রাজধানীর গুলশান-১ এ দেশ রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করেছেন। ২০১৮ সাল থেকে ইন্টারনেটের ব্যবসায় নামেন সাধন। বাড্ডা এলাকার বিএনপি নেতা ও সাবেক কমিশনার কাইয়ুমের সঙ্গে পারিবারিক সুসম্পর্ক রয়েছে। কাইয়ুমের একটি ভবনে তিনতলায় স্ত্রীসহ বসবাস করছিলেন সাধন। একই ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকেন কাইয়ুমের ভাগনে কামরুল ইসলাম বাবুল। এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনার সময় একই স্থানে উপস্থিত ছিলেন ভাগনে বাবুলও।

এর আগে রোববার (২৫ মে) রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট-৪ নম্বর গলিতে গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। 

পরে রক্তাক্ত অবস্থায় সাধনকে উদ্ধার করে অটোরিকশায় করে চিকিৎসার জন্য মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার বুকের ডানে-বামে, পিঠে ও ঘাড়ে গুলি লেগেছে। সেখান থেকে পরে তা মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। 

ঘটনার পর সাধনকে লক্ষ্য করে দুই যুবকের এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

ঘটনাস্থলের পরশ টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিক নামক প্রতিষ্ঠানে থাকা সিটিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, মোড়ে একটি দোকানের বাইরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করছিলেন কামরুল আহসান সাধন। রাত ১০টা থেকে ১০টা ১০ এর মধ্যে দুজন হেঁটে এসে পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে দৌড়ে পালিয়ে যান। এতে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলের আশপাশে অনেকের উপস্থিতি থাকলেও হত্যাকারীদের আটকতে কাউকেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।  

এদিকে সোমবার (২৫ মে) দুপুরে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, রশি দিয়ে কর্ডন করে রেখেছে পুলিশ। রক্তের ছোপ ছোপ দাগ তখনও লেগেছিল পিচঢালা সরু গলিতে। দুপুরেও সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় সাধনের পায়ের জুতা।

ঘটনাস্থলের ঠিক উল্টোপাশের চায়ের দোকানদার হানিফ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধন ভাই মাঝে মাঝে এখানে এসে বসেন। চা খান, গল্প করেন, চলে যান। গতকাল দোকানে বেশ কয়েকজন কাস্টমার ছিল কথা বলছিলাম, চা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ, এরপর লোকজনের ছুটোছুটি। কিছু বুঝে ওঠার আগে আমিও দোকান থেকে বাইরে বের হই। দোকানের অর্ধেক শাটার নামিয়ে দৌড় দেই। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে দেখি ঘটনাস্থলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন সাধন ভাই।

হানিফ জানান, ঘটনার সিসিটিভির ফুটেজ আমিও দেখেছি। কিন্তু শ্যুটার দুই ছেলেকে চেনা যায়নি।

ঘটনার সময় একসঙ্গে বসা ছিলেন জাকির হোসেন রুপক, আবুল হোসেন, কামরুল ইসলাম বাবুল আর খুন হওয়া বিএনপি নেতা কামরুল ইসলাম সাধন। সবাই বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিএনপি নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার কাইয়ুমের ভাগনে কামরুল ইসলাম বাবুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা একসঙ্গে বসা ছিলাম। সাধন মোবাইল টিপছিল আর কথা বলছিল। হঠাৎ দুজন এসে এলোপাতাড়ি গুলি করে। দু’জনই মাস্ক পরা ছিল। গুলিতে সাধন ঘটনাস্থলেই পড়ে যান। আমি কোনোরকম হামাগুড়ি দিয়ে সটকে পড়ি। এরপর ফাঁকা গুলি করতে করতে পালিয়ে যায় ওই দুই সন্ত্রাসী। 

বাবুল বলেন, আমরা একই ভবনে থাকি। ও বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে এসেছে। আমি ওকে ফোন করে ডাকিনি। কিন্তু কে বা কারা, কেন কি উদ্দেশ্যে ওকে টার্গেট করে হত্যা করলো তা এখনও বুঝতে পারছি না।

স্বদেশ কমিউনিকেশনস নামক ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় ভবনের কেয়ারটেকার আবুল হাশেমের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিন বলেন, গুলির ঘটনার ৫/৭ মিনিট আগেও আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি ইন্টারনেটের দুটি সার্ভার বক্স হাতে করে নিয়ে এসে এখানে রেখে ওই মোড়ের উপর চায়ের দোকানে যান। এরপরেই তো ঘটনা ঘটলো।

মধ্য বাড্ডার ট ৫৬/৭ বাসার তিনতলায় স্ত্রীর দিলরুবা আক্তারকে নিয়ে বসবাস করতেন সাধন। সোমবার দুপুরে সেখানে গিয়ে কথা হয় সাধনের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে।

কিশোরগঞ্জ থেকে আসা সাধনের ভায়রা রফিকুল ইসলাম বলেন, ছোটোবেলা থেকেই সাধন এখানেই বড় হওয়া। অত্যন্ত মার্জিত ভদ্র নামাজি একটি ছেলে। ঝামেলার ইন্টারনেটের ব্যবসা করলেও কারো সঙ্গে কখনো বিবাদ বা দ্বন্দ্বের কথা শুনিনি। অথচ কে বা কারা এসে খুন করে গেল সাধনকে। 

সাধনের স্ত্রী দিলরুবা আক্তারের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুরে। সাধনের মৃত্যুর খবরের রাতেই ঢাকায় আসেন দিলরুবার বড় ভাই স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধনের ইন্টারনেটের ব্যবসা। নিজেই সময় দিয়ে পরিচালনা করছিল। বোনের কাছে কখনো কোনো অভিযোগ শুনিনি। নির্ভেজাল একটা ছেলে। কে বা কারা সাধনকে টার্গেট করে খুন করতে পারে! এখনো আমরা বুঝে উঠতে পারছি না।

স্ত্রী দিলরুবা আক্তার কান্নারত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘লোকটা রাতে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র আর বিস্কিট কিনে নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো এখনো অক্ষত আছে। উনি যখন বাসায় আসেন আমি নামাজে। বললাম বসেন। তিন রাকাত নামাজ শেষ করে খাবার দিচ্ছি। একটা কল আসলো। রিসিভ করে দরজা বাইরে থেকে লক করে বের হন। আমি নামাজ শেষে খাবারও টেবিলে সাজাই। কিন্তু সেই খাবার আর কারোরই খাওয়া হয়নি। তার আগেই আসে মৃত্যুর খবর।’

তিনি বলেন, ‘মামলা করেছি, পুলিশ তদন্ত করছে, আপনারাও (সাংবাদিক) ভাই একটু দেখেন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কে বা কারা কেন খুন করতে পারে সাধনকে! দয়া করে বের করেন, আমি জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দা ও ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে চারজন বা একাধিক। আমরা বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখেছি। একই এলাকার ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩৫০ ফিট দূরত্বে ডাক্তার জিয়ার বাড়ির কোনায় চারজনকে একসঙ্গে কথাবার্তা বলতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে মুখে মাস্ক পরা দুজন হেঁটে আসে। এরপর ঘটনাস্থলের ওই গুলির শেষ মাথায় লেকের ধারে চলে যান। সেখান থেকে ফিরে এসেই তারা শুধুমাত্র সাধনকে লক্ষ্য করে চারটি গুলি করেন। 

স্থানীয় ওই বাসিন্দার ধারণা, পরিকল্পনা করে রেকির পর গুলি ছুড়ে সাধনকে হত্যা করা হয়েছে। শ্যুটার দুজনেই ২০ থেকে পঁচিশ বছর বয়সী হবে।

অন্যদিকে, সোমবার সকালে নিহতের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৩৩। মামলায় আসামিরা অজ্ঞাত।

এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, গুদারাঘাট চার নম্বর রোডে দুজন যুবক বিএনপি নেতা কামরুলকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ঘটনার জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সিসি ক্যামেরা ফুটেজে যে দুজনকে গুলি করতে দেখা গেছে, তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এখন তাদেরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এরইমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা ছিনতাইয়ের উদ্দেশে গুলির কোনো ঘটনা নয়, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণের পর আমাদের স্পষ্ট মনে হয়েছে যে, এটা টার্গেটেড কিলিং। কারণ টার্গেট করে শুধু সাধনকেই গুলি করা হয়েছে। 

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের সঙ্গে আমরা ভিডিওটি নিয়ে কথা বলেছি। দুই শ্যুটারকে তারা কেউ চিনতে পারছেন না। আমাদের মনে হয়েছে, হয়তো এই দুই শ্যুটার ঢাকার বাইরে থেকে কিলিং মিশনে এসেছিল। 

এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কি হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ২০ মার্চ গুলশান পুলিশ প্লাজার পাশে শুটিং ক্লাবের সামনে একইভাবে সুমন নামে এক ইন্টারনেট ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গতকাল রাতে সাধন নামে ওই বিএনপি নেতাকে একই কায়দায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দুই ঘটনাই খুবই কাছাকাছি ও সিমিলার মনে হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবসা কব্জা করা নিয়ে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে এটা আমাদের প্রাথমিক ধারণা। তদন্তের অগ্রগতিতে বোঝা যাবে আসলে হত্যার নেপথ্যের কারণ কি।

গুলশান থানা বিএনপির আহ্বায়ক শরিফ উদ্দিন আহমেদ মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধন আমার ছোটোবেলার বন্ধু আমরা একসঙ্গে পলিটিক্স করছি এবং আমার কমিটিতেই সে যুগ্ম আহ্বায়ক। রাজনৈতিক কর্মসূচি কখনোই মিস করত না সাধন। ওর ইন্টারনেটের ব্যবসা। ব্যবসা বা রাজনৈতিক কোনো প্রতিপক্ষ ওর ছিল বলে আমি কখনো শুনিনি। কে বা কারা কেন তাকে হত্যা করতে পারে এটা আমার মাথায় আসছে না। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত জড়িতদের গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

জেইউ/জেডএস