শৌচাগারের জন্য ফুটপাত বরাদ্দ, পুলিশের ‘না’!
চট্টগ্রাম নগরের কাজীর দেউড়ি মোড়ে সার্কিট হাউসের বিপরীতে অবস্থিত ফুটপাতের একটি অংশ শৌচাগার নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। ৫৫০ বর্গফুটের ফুটপাতটি ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিএনপির একজন নেতাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে মাসিক ভাড়া ধরা হয়েছে মাত্র ১৫০০ টাকা। গত ৪ জুন চসিকের সঙ্গে চুক্তি করে নির্মাণকাজ শুরু করেন আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি সংসদের চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন।
যে স্থানে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে সেটির পাশে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের একটি বক্স ও একটি সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। এ কারণে শৌচাগার নির্মাণের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর চসিককে চিঠি দিয়েছে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, ট্রাফিক বক্সের পাশের অংশটি টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সেখানে ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্মাণ কাজ চলিতেছে, বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’ লেখা কয়েকটি ব্যানার সাঁটানো রয়েছে। ফুটপাতে পথচারীদের পাশাপাশি দৃষ্টিহীন ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নির্বিঘ্ন চলাচলের জন্য মাঝখানে একটি নির্দিষ্ট চিহ্ন থাকে। অথচ চসিক সেই চিহ্নিত অংশ পর্যন্ত শৌচাগার নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে, যা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং নৈতিকভাবেও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
চিঠিতে সিএমপি চসিককে যা বলেছে
এদিকে, চসিকের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে নগর ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসফিকুজ্জামান আক্তারের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কাজীর দেউড়ি গোলচত্বরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি গণশৌচাগার নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। ট্রাফিক বিভাগ হিসেবে আমরা মনে করি, প্রস্তাবিত স্থানটি জনস্বার্থ এবং এলাকার সার্বিক পরিবেশের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। প্রস্তাবিত স্থানটির একপাশে ট্রাফিক পুলিশের বক্স এবং অপরপাশে সার্ভিস ডেস্ক রয়েছে। এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এখানে গণশৌচাগার হলে দুটি স্থাপনার কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘স্থানটির খুব কাছে ঐতিহাসিক সার্কিট হাউস অবস্থিত। সার্কিট হাউসে ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের আসা-যাওয়ার অন্যতম স্কয়ার হিসেবে কাজীর দেউড়ি মোড় গণ্য হয়ে থাকে। এছাড়া মোড়টি নগরীর অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় ও জনসমাগমপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক লোক পরিবার ও বন্ধুবান্ধবসহ এখানে আসেন। তারা সামাজিক বিনোদন, আলাপ-আলোচনা এবং স্থানীয় সড়কের পাশে খাদ্য উপভোগ করেন। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নান্দনিক স্থানে গণশৌচাগার নির্মাণ করা হলে সিএমপির নিরাপত্তা স্থাপনার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি, এলাকার সার্বিক গণস্বাস্থ্যের ওপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব, এলাকার সৌন্দর্য ও পরিবেশের অবনতি, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ও সামাজিক বিনোদনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি এবং জনমনে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে।’
উচ্ছেদ করা ফুটপাত আবার বরাদ্দ দিল চসিক
স্টেডিয়াম সংলগ্ন ফুটপাত এলাকায় ২০১৮ সালে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে লিজ দিয়েছিলেন। সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় পাঁচ বছরের জন্য ই-টেন্ডারের মাধ্যমে দোকানগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সেখানে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় ফুড জোন, পাবলিক টয়লেট, যাত্রী ছাউনি, ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও নার্সারি।
তবে, ফুটপাত দখল করে গড়ে তোলা এসব স্থাপনা জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় ২০২৩ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নু-এমং মারমা মং-এর নেতৃত্বে একটি অভিযান পরিচালিত হয়। ওই অভিযানে নার্সারি, রেস্তোরাঁসহ বেশ কয়েকটি দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, যেগুলো তখন অবৈধ স্থাপনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, স্থাপনাগুলো নির্মাণ আইনসম্মত ছিল না।
উচ্ছেদের পর প্রশাসন ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে এক কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে সেখানে উন্নয়ন কাজ শুরু করে। আউটার স্টেডিয়াম ও ফুটপাত আধুনিকায়ন এবং স্টেডিয়ামের সীমানা নির্ধারণসহ জনসাধারণের জন্য হাঁটাচলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্য বর্ধন করার পর বদলে যায় পুরো এলাকা। সম্প্রতি আবারও চসিক কর্তৃক সেই জায়গায় স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেটি নিয়ে পথচারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিভিন্ন পদে চেহারা পরিবর্তন হয়েছে। বাস্তবে কোনো পরিবর্তনই হয়নি। আগের লোকেরাও অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে, এখনো হচ্ছে। এটি দুঃখজনক। চসিকের শীর্ষ পদে যিনি আছেন, তিনি ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর বসেছেন। এত লোকের প্রাণহানির পর যিনি পদে বসেছেন, তার প্রতি জনগণের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু তিনি যদি আগের মতো জনগণের হাঁটার পথ দখল করেন, তাহলে করার কিছু নেই। আমি আহ্বান জানাচ্ছি, চসিক যেন এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।’
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এস এম সরওয়ার কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিপরীত পাশে সার্কিট হাউস, ভিআইপিদের যাতায়াতসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা মেয়রকে চুক্তি বাতিলের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। উনার অনুমতি পেলে আমরা বরাদ্দ বাতিল করে দেব।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি। তবে, চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রথমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, পরে পুলিশের আপত্তি আমরা পেয়েছি। বিষয়টি আমরা পুনরায় বিবেচনা করব।’
এমআর/এমএআর/