বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক (ডিজি) পর্যায়ের ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলন শুরু হচ্ছে আগামীকাল মঙ্গলবার। চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা, পুশইন, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ বিভিন্ন আন্তঃসীমান্ত অপরাধমূলক বিষয়ে আলোচনা হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিজিবির দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সম্মেলনে কারা এলেন, থাকবেন কোথায়

মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিএসএফ মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরী নয় সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। সোমবার (২৫ আগস্ট) বিকেল ৩টা ৪৩ মিনিটে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের (৬ই-১১০৩) একটি ফ্লাইটে তারা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান।

প্রতিনিধি দলে রয়েছেন– বিএসএফের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মহেশ কুমার আগারওয়াল, বিএসএফের পরিদর্শক জেনারেল সুমিত শরণ, ডিআইজি বিকাশ মোহন সিং, স্টাফ অফিসার ব্রিজেশ ইয়াদাভ, ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব অক্ষয় অশোক শিন্ডে, ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পরমজিৎ সিং, ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি মধুরি গাড্ডাম।

ভারতের প্রতিনিধি দল বিজিবি অফিসার্স মেসে অবস্থান করবেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সম্মেলন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে। তাছাড়া ভারতের পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের ‘পুশইন’ করার ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে।

কোথায় কোথায় যাচ্ছে বিএসএফ প্রতিনিধি দল

ঢাকা পোস্টের হাতে আসা বিসিএফ প্রধানের সফরসূচিতে দেখা গেছে, মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) প্রতিনিধি দল সম্মেলনের পাশাপাশি ভারতীয় হাইকমিশনে যাবে। হাইকমিশনে রাতের খাবার খেয়ে আবার সীমান্ত কুঞ্জ বা বিজিবি অফিসার্স মেসে যাবে প্রতিনিধি দলটি। ২৭ আগস্ট ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন ও  কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব পরিদর্শন করবেন তারা। এ দিনই শুধু বিএসএফ ডিজি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং পিলখানায় ফিরবেন। এদিন অন্য প্রতিনিধিরা জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। এছাড়াও বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে তাদের শপিং করার কথা রয়েছে। ২৮ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রতিনিধি দলটি ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবে।

নেতৃত্ব দেবেন বিজিবি-বিএসএফ প্রধান

বিজিবি সদর দপ্তরে অনুষ্ঠাতব্য এ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেবেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। অন্যদিকে ভারতের পক্ষ থেকে বিএসএফ মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরী একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন।

আলোচনায় যেসব বিষয় প্রাধান্য পাবে

পুশইন : সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত ৭ মে থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ভারত বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ২ হাজার ১৯৭ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে। এর মধ্যে সিলেট ও মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে পুশইন করা হয়েছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এমনকি মিয়ানমার ও নিজ দেশের নাগরিকদেরও বাংলাদেশে পুশইন করছে, যা দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন।

সীমান্ত হত্যা : সম্মেলনে সীমান্ত হত্যার মতো সংবেদনশীল বিষয়টিও অগ্রাধিকার পাবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে কমপক্ষে ১৭ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, যা গত বছরের তুলনায় বেশি।

অন্যান্য অপরাধ : পুশইন ও সীমান্ত হত্যার পাশাপাশি মাদক, অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালান এবং সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণসহ অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন নিয়েও আলোচনা হবে সম্মেলনে। বিএসএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে।

বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, বিজিবি সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে অননুমোদিত নির্মাণ, অভিন্ন নদীর পানির সুষ্ঠু বণ্টন এবং ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা হ্রাসের বিষয়গুলো উত্থাপন করার পরিকল্পনা করেছে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, এ সম্মেলনে বিজিবি দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্মেলনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন যেমন প্রকট হয়েছে, তেমনি সীমান্তে বাস্তব সমস্যাগুলোও এখন তীব্র আকার ধারণ করছে।

তিনি বলেন, ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের অব্যাহতভাবে পুশইন করার ঘটনা শুধু মানবিক সংকটই সৃষ্টি করছে না, এটি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চুক্তি ও আস্থারও বড় ধরনের লঙ্ঘন। একদিকে ভারতের দিকে থেকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ ঠেকাতে কঠোর অবস্থান দেখাচ্ছে, অন্যদিকে নিজেদের সমস্যা এড়াতে নানা দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে তারা। এ ধরনের পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে সীমান্ত ব্যবস্থাপনাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

‘এ ছাড়া সীমান্ত হত্যা ইস্যুটি বাংলাদেশিদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। এ পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তাতে বোঝা যায় বিএসএফের শাস্তিমূলক বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অতিরিক্ত মাত্রায় প্রাণঘাতি হচ্ছে। সীমান্তে প্রাণঘাতি অস্ত্রের পরিবর্তে অপ্রাণঘাতি কৌশল ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি ভারত বারবার দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন, বিজিবিকে এ সম্মেলনে খুব শক্ত অবস্থান নিতে হবে। বিশেষ করে তিনটি বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে– 
১. পুশইন বন্ধে কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি
২. সীমান্ত হত্যার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা
৩. আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন

কাজী শরীফ উদ্দীন বলেন, দেশের স্বার্থ রক্ষায় বিজিবিকে চোখে চোখ রেখে কথার বলার সক্ষমতা রাখতে হবে। শুধু কাগুজে আলোচনা না করে যদি যৌথ পর্যায়ে বাস্তবায়নযোগ্য রোডম্যাপ তৈরি হয়, তাহলেই এ সম্মেলন ফলপ্রসূ হবে। নইলে অতীতের মতো এবারও শুধু সৌজন্য বৈঠকেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞ মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের এ সম্মেলন কেবল নিরাপত্তা বা সীমান্ত ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন নয়, বরং এটি আঞ্চলিক কূটনীতি ও মানবাধিকার প্রসঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে ‘পুশইন’ ইস্যুটি বর্তমানে সবচেয়ে গুরুতর। ভারতের পক্ষ থেকে যেভাবে বাংলাদেশে মানুষকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশন ও আঞ্চলিক সহযোগিতার নীতিমালা অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিক বা তৃতীয় দেশের নাগরিককে এভাবে অন্য দেশে পাঠাতে পারে না। এটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অপরাধ বলেই আমি মনে করি।

তিনি বলেন, সীমান্ত হত্যার প্রশ্নটিও অত্যন্ত সংবেদনশীল। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ বললেও প্রতি বছর নিরীহ বাংলাদেশিদের প্রাণহানি দ্বিপাক্ষিক আস্থাকে দুর্বল করে। আমি মনে করি, প্রাণঘাতি অস্ত্রের পরিবর্তে অপ্রাণঘাতি প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি শুধু আলোচনায় নয়, কার্যকর চুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।

এ ছাড়া মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান দুই দেশের নিরাপত্তার জন্য সমান হুমকি। তাই যৌথ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ।

মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো– এই সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো যাতে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়। অতীতে দেখা গেছে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অনেক ভালো সিদ্ধান্ত হলেও মাঠপর্যায়ে তা কার্যকর হয়নি। এবার যদি পারস্পরিক দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, তবে সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের জীবনের সঙ্গে জড়িত। তাই দুই দেশের পক্ষেই দায়িত্বশীল আচরণ করা অত্যন্ত জরুরি। পুশইন, সীমান্ত হত্যা কিংবা চোরাচালান– এসব সমস্যার সমাধান একপক্ষীয় পদক্ষেপে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার ভিত্তিতে যৌথ উদ্যোগ।

তিনি বলেন, আমি মনে করি বিজিবি-বিএসএফ সম্মেলনকে কেবল অভিযোগ তোলার মঞ্চ হিসেবে না দেখে সমাধানমুখী আলোচনার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। একে অপরের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে প্রতিবেশীর কাঁধে চাপিয়ে দিলে সংকট কখনোই কমবে না। বরং দুই দেশ যদি দায়িত্বশীলভাবে আলোচনায় আসে এবং মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ নেয়, তবে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

এমএম/এসএসএইচ