বিমানবন্দর সড়কে দীর্ঘ যানজট / ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

মিরপুর-১২ থেকে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে নুর-এ মক্কা পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন আবদুর রহমান। বাস চলা শুরুর পর জিল্লুর রহমান উড়াল সেতুতে ওঠার আগেই যানজট শুরু হয়। তিনি এই উড়াল সেতুর ওপরই যানজটে ছিলেন দেড় ঘণ্টা।

বললেন, ‘গাড়ি নড়ছিলই না। কী কারণে এ অবস্থা তা-ও জানতে পারিনি। কুড়িল উড়াল সেতু থেকে প্রগতি সরণি অংশে যানজটে ঠায় দাঁড়িয়ে নষ্ট হয়েছে আরও আধঘণ্টা। সকাল পৌনে ১১টায় তিনি বারিধারায় তার কর্মস্থলে পৌঁছান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য দিন তিনি আধা ঘণ্টায় এ পথ বাসে অতিক্রম করেন। কিন্তু আজ অনেক বেশি সময় লেগেছে এবং ভোগান্তিও হলো বেশি।

মঙ্গলবার (১৫ জুন) রাজধানীর মহাখালী থেকে বিমানবন্দর সড়ক হয়ে একেবারে গাজীপুর পর্যন্ত যানজট তীব্র ছিল। স্থানে স্থানে যানজটের কারণ ছিল সড়কে বৃষ্টির পানি জমে চলাচলের পথ কমে যাওয়া। যাত্রী ও চালকরা অভিযোগ করেন নিকুঞ্জ-১ গেটের সামনের সড়ক, ইসিবি চত্বর ও কুড়িলে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের দেখা গেলেও তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি।

বিমানবন্দর সড়কের কুড়িলে রাইদা পরিবহন, তুরাগ পরিবহন, প্রজাপতি পরিবহনসহ বিভিন্ন বাসের চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল সাতটার আগে থেকেই যানজট শুরু হয়েছে। এ যানজটে আটকে পড়ে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোও। 

যানজটের কবলে পড়ে রাজধানীতে কারও কারও গন্তব্যে যেতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। মঙ্গলবার সকালে ইসিবি চত্বর থেকে বিমান বন্দর সড়কে প্রজাপতি পরিবহনের বাসে বসে ঘামছিলেন অফিসযাত্রী শিমু রহমান। বাইরে বৃষ্টি হলেও তিনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ঘামছিলেন। বললেন, অফিসে (উত্তরা) আজ সময়মতো যেতে পারব না। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ৯টা ছুঁইছুঁই। তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই সময়মতো অফিসে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আজ অবস্থা ভয়াবহ।

মঙ্গলবার সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে সড়কের অনেক জায়গায় পানি জমে যাওয়ায় যান চলাচলের অংশ কমে যাওয়া ছাড়াও ৬টি মেগা প্রকল্পের নির্মাণ কাজে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও যান চলাচলের উপযোগী ব্যবস্থাপনার অভাবে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে চলাচলকারী যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহাখালী বাস টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় বাসের প্রথম ট্রিপ এখনো আসেনি। আর সকালে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোর কিছু বিমানবন্দর সড়কে আটকে থাকতে থাকতে এখন গাজীপুরে আটকে আছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দর সড়কে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে সমন্বয় না থাকায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে। যে যার মতো কাজ করছে। বৃষ্টি হলে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, উন্নয়ন কাজে সমন্বয় না থাকায় সড়কে যান চলাচলে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। বৃষ্টির পানি সামান্য জমলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এজন্য উপযোগী মানের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা দরকার। উড়ালসেতু করলেই হবে না। এখন উড়ালসেতুতে যানজটে বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সুফল মিলবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমান বন্দর সড়কে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের জট লেগেছে। সেখানে গোল চত্বরের কাছে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রীও ফেলে রাখা হয়েছে। কোথাও চলার পথ কমে গেছে প্রকল্পের কাজের জন্য। ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। বিমানবন্দর সড়কের পাশ ঘেঁষে নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকার প্রথম উড়ালসড়ক বা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এই প্রকল্পের কাজের জন্য মূল সড়কের বনানী, মহাখালী থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে প্রকল্পে। শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীর‌্ন্তয এ উড়াল সড়ক নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।

মেট্রো রেলপথ-১ ও ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বিমানবন্দর গোলচত্বরের কাছ থেকে। বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড মেট্রো রেল-১ বাস্তবায়ন করছে। ব্যয় হবে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। আশুলিয়া উড়াল সড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বিমানবন্দর গোলচত্বরে আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য কাজ পুরোদমে শুরু হবে। বিআরটি প্রকল্পের অধীনে এটি নির্মাণ করা হবে। বিমানবন্দর গোলচত্বরের নিচ দিয়ে ৬২০ মিটার দীর্ঘ হবে আন্ডারপাস। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২১ কোটি টাকা। এছাড়া বিমানবন্দর রেলস্টেশনকে ঘিরে নির্মাণ করা হবে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত এই সড়কে (বিমানবন্দর সড়ক) বিভিন্ন সংস্থার এত বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো সমন্বয় নেই। এই পথে তৈরি করা ইউলুপগুলোও সেই অর্থে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখছে না। বরং ইউলুপের কারণেও কিছু কিছু জায়গায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে যানজট আরো বাড়বে।

পিএসডি/এসএম/জেএস