যমুনার সরবরাহ বন্ধ-সিলগালা ফিলিং স্টেশন, তবুও চলছে তেলের ব্যবসা!
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কর্তৃপক্ষের (জেওসিএল) চুক্তি বাতিল ও আদালতের আদেশ বহাল থাকার পরও চট্টগ্রাম নগরের সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় অবৈধভাবে চলছে ইমাম শরীফ ফিলিং স্টেশন।
অভিযোগ উঠেছে, চুক্তি বাতিল হওয়া এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের সিলগালা ভেঙে দীর্ঘ দিন ধরে চোরাই তেল বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এই অবৈধ কার্যক্রমে জেওসিএলের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশের অভিযোগ উঠলেও রহস্যজনকভাবে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
একাধিক সূত্রে জানা যায়, নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২২ সালের ১০ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম নগরের সল্টগোলা ক্রসিং এলাকার ইমাম শরীফ ফিলিং স্টেশনে তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছে যমুনা অয়েল কর্তৃপক্ষ। এরপরও ফিলিং স্টেশনটিতে তেল বিক্রি বন্ধ হয়নি। পরে চোরাই তেল বিক্রির দায়ে ওই বছরের ২০ এপ্রিল ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ফিলিং স্টেশনটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। সেই সিলগালা খুলে অব্যাহত রয়েছে তেল বিক্রি।
অভিযোগ উঠেছে, বছরের পর বছর ধরে যমুনা অয়েলের ডিপো থেকে অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যোগসাজশে তেল চুরি করে ফিলিং স্টেশনটিতে বিক্রি করছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস থেকে চোরাই তেল সংগ্রহ করা হয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
সল্টঘোলা এলাকায় অবস্থিত ফিলিং স্টেশনটিতে সরেজমিনে দেখা গেছে, একটি ট্রাকে থাকা বিভিন্ন ড্রাম থেকে তেল স্টোরেজে লোড করা হচ্ছে। একই সময়ে ফিলিং স্টেশনে বিভিন্ন গাড়িতে তেল বিক্রি হচ্ছে একেবারে স্বাভাবিক নিয়মে।
জানা যায়, ফিলিং স্টেশনটির প্রথম ডিলার ইমাম শরীফের মৃত্যুর পর সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে এক মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় ইমাম শরীফ ফিলিং স্টেশনটিতে আদালত রিসিভার নিয়োগের সিদ্ধান্ত দেয়। ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে দেওয়া সেই আদেশের পর রিসিভার হিসেবে নিজেকে নিয়োগ দিতে মুসলিম খান আবেদন করেন। তবে মুসলিম খানের আবেদন খারিজ করে দেন আদালত। পরে অ্যাডভোকেট মাহমুদুর রহমান নামে এক আইনজীবীকে রিসিভার নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলেন আদালত। আদালতের আদেশ পাওয়ার পরও দখলে থাকা মুসলিম খানের অসহযোগিতায় রিসিভার নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেননি অ্যাডভোকেট মাহমুদুর রহমান।
এদিকে আদালতের আদেশ অমান্য করে জেওসিএল কর্তৃপক্ষ মুসলিম খান এবং তার মৃত্যুর পর ছেলে এহেতাশাম রসুল খানকে দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকে। তবে বছরের পর বছর নিজেদের বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যান্য ভাইকে বঞ্চিত করে মুসলিম খানের একাই ভোগ করার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেয় ভাই মহসিন খান। এটি নিয়ে পরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের একটি টিম তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে তারা একটা প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনে জেওসিএল কর্তৃপক্ষের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে মুসলিম খান ও তার ছেলেরা একাই ফিলিং স্টেশন ভোগদখল করছে বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২২ সালের ৮ মার্চ মুসলিম খানের ছেলে এহেতাশামের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে যমুনা অয়েল এবং ১০ মার্চ থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জেওসিএলের এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে এহতেশাম রসুল খান। পরে চলতি বছরের ১০ জুন আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেনের বেঞ্চ রিট পিটিশনটি খারিজ করে দেন। এতে করে যমুনা অয়েলের সিদ্ধান্ত বহাল থেকে যায়।
যমুনা অয়েল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পরও বছরের পর বছর ফিলিং স্টেশন চালু রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে এহেতাশাম রসুল খান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে ইমাম শরীফের আরেক উত্তরাধিকারী মহসিন খান বলেন, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মুসলিম খান এবং তার ছেলে ফিলিং স্টেশনটি অন্যান্য ভাইদের বঞ্চিত করে ব্যবসা করে আসছে। আমরা এ বিষয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আদালত প্রতিষ্ঠানটিতে রিসিভার নিয়োগ করে লভ্যাংশ ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে বলেছেন। তবে প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও আদালতের সেই আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। পরবর্তী সময়ে আমরা অভিযোগ দিলে যমুনা কর্তৃপক্ষ তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এরপরও চোরাই তেল দিয়ে বিক্রি অব্যাহত রেখেছে তারা। বিষয়টি আমরা যমুনা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তবে এসবের পরও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
যমুনা অয়েলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (সেলস) মোহাম্মদ হাসান ইমাম বলেন, আমরা তাদের ডিলারশিপ বাতিল করেছি। বিপিসিসহ (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি, যাতে এটির ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর আগে একবার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ফিলিং স্টেশনটি সিলগালা করা হয়েছিল এবং নিরাপত্তার জন্য একজন আনসার সদস্য দেওয়া হয়েছিল। আনসার সদস্যকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আবার তারা এটি চালু করেছে। এখন বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ ফিলিং স্টেশন বন্ধের জন্য মোবাইল কোর্ট চলছে। বিপিসির মাধ্যমে এখানেও মোবাইল কোর্ট চালিয়ে বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে।
আরএমএন/এমজে