বাতাসে বিষ, নগরে ‘নীরব মৃত্যু’: দূষণ ঠেকাতে ব্যর্থ সব উদ্যোগ!
বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শুয়ে আছেন মো. হাফিজুল (৪৫), পেশায় রিকশাচালক। এক মাস ধরে কাশি আর শ্বাসকষ্টে ভুগে শেষে বাধ্য হয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিবার শ্বাস নিতে গেলে তার বুকটা ফুলে ওঠে, চোখে-মুখে মেলে ক্লান্তির ছাপ। পাশে বসে থাকা স্ত্রী বারবার পাখা দিচ্ছেন, তবুও ঘামে ভিজে যাচ্ছে তার শরীর।
রাজধানীর রামপুরা-বাড্ডা এলাকার সড়কে রিকশা চালান হাফিজুল। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জীবিকার সন্ধানে ছুটে বেড়ান তিনি। কষ্টের মাঝেও তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস— ‘ভাই, সারাদিন রাস্তায় থাকি। একদিকে বাসের কালো ধোঁয়া, অন্যদিকে ধুলা-ময়লা। মুখে কাপড় বেঁধে রাখি, তারপরও ধোঁয়া গলায় ঢুকে যায়। বাসায় ফিরে দেখি শরীরটা ধুলায় মাখামাখি, চোখ-মুখ জ্বলে। রাতে ঘুমোতে গেলেও বুকটা চেপে আসে। মনে হয় কেউ যেন ভিতর থেকে টানছে।’
বিজ্ঞাপন
গত এক মাসে তিনবার বুকে ব্যথা বেড়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় হাসপাতালে আসতে বাধ্য হয়েছেন। চিকিৎসকরা তাকে কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন, কিন্তু তিনি বলেন, ‘বিশ্রাম নিলে খাব কী দিয়ে? দুই দিন না চালালে সংসার চলে না। আবার রাস্তায় নামতে হয়... আবার ধোঁয়া গলায় ঢোকে।’
হাফিজুলের চোখে-মুখে এখন আতঙ্ক। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি বলেন, ‘এখন আর আগের মতো জোরে রিকশা চালাতে পারি না। সামান্য উঠানামা করলেই বুক ধড়ফড় করে। মনে হয় এই শহরের ধোঁয়া এক দিন আমাকেই শেষ করে দেবে।’
বিজ্ঞাপন
রামপুরা-বাড্ডা সড়কের পাশ দিয়ে প্রতিনিয়ত যে বাসগুলো চলে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই ফিটনেস নেই। ইঞ্জিন থেকে ঘন কালো ধোঁয়া বের হয় অবিরাম। রিকশা চালানোর সময় প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন বিষাক্ত হয়ে ওঠে। ফলে এই চিত্র শুধু রিকশাচালক হাফিজুলের নয়, এই সড়কে চলাফেরা করা নিত্যনৈমিত্তিক পথচারীদের অবস্থাও হাফিজুলের মতো। সবমিলিয়ে পুরো রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষ এখন এমনই শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, কাশি ও ব্রঙ্কাইটিসে ভুগছেন
হাফিজুলের গল্প আসলে হাজারও শ্রমজীবী মানুষের। তারা প্রতিদিন এই শহরের বিষাক্ত বাতাসে বাঁচেন, কাজ করেন, শ্বাস নেন— আর ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
রামপুরা-বাড্ডা সড়কের পাশ দিয়ে প্রতিনিয়ত যে বাসগুলো চলে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই ফিটনেস নেই। ইঞ্জিন থেকে ঘন কালো ধোঁয়া বের হয় অবিরাম। রিকশা চালানোর সময় প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন বিষাক্ত হয়ে ওঠে। ফলে এই চিত্র শুধু রিকশাচালক হাফিজুলের নয়, এই সড়কে চলাফেরা করা নিত্যনৈমিত্তিক পথচারীদের অবস্থাও হাফিজুলের মতো। সবমিলিয়ে পুরো রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষ এখন এমনই শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, কাশি ও ব্রঙ্কাইটিসে ভুগছেন।
আরও পড়ুন
শিশু-প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, ওষুধও এখন কাজ করে না
চিকিৎসকরা বলছেন, ঢাকার বাতাস এখন অনেকটাই ‘বিষাক্ত’। এর বড় কারণ ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক ও মাইক্রোবাস থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া এবং তীব্র শব্দদূষণ। ধোঁয়ায় থাকা ক্ষুদ্র কণাগুলো ফুসফুসে জমে থেকে শ্বাসযন্ত্রকে ধীরে ধীরে অকেজো করে ফেলে।
বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফাতেহ আকরাম দোলন বলেন, ‘এই ধরনের রোগীদের ফুসফুসে দূষিত ধোঁয়ার কণা জমে গেছে। চিকিৎসা দিচ্ছি, কিন্তু প্রতিদিন যদি আবার সেই একই ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে হয়, তাহলে ওষুধেও কাজ হয় না।’
‘বায়ু ও শব্দদূষণ সরাসরি শ্বাসযন্ত্র ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আমরা এখন প্রতিদিনই এমন রোগী পাই যারা শহরের ধোঁয়া ও শব্দের কারণে শ্বাসকষ্ট, হাইপারটেনশন বা নিদ্রাহীনতায় ভুগছেন।’
ডা. দোলন জানান, শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। শব্দদূষণ কানে স্থায়ী ক্ষতি, উদ্বেগ, উচ্চ রক্তচাপ ও মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর কণা ফুসফুসে জমে থেকে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেরা ১০০ ডেসিবেল শব্দে
রাজধানী ঢাকার বায়ু ও শব্দদূষণ এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে প্রতিদিনের শ্বাস-প্রশ্বাস ও শ্রবণ স্বাভাবিক থাকা একপ্রকার সৌভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)–এর সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার কোনো নাগরিকই আর ‘নির্মল বাতাসে’ নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না, আর নগরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে রয়েছে ভয়াবহ শব্দদূষণে।
শব্দদূষণ সংক্রান্ত এই জরিপে রাজধানীর ১২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএএফ শাহীন কলেজ ও কিডস টিউটোরিয়াল স্কুলের সামনে শব্দের মাত্রা ছিল সর্বোচ্চ ১০০.৭৬ ডেসিবেল, যা আন্তর্জাতিক মানের প্রায় দ্বিগুণ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (৯৩.০৪ ডেসিবেল) এবং তৃতীয় স্থানে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ (৯২.৯২ ডেসিবেল)।
আরও পড়ুন
এছাড়া ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, খিলগাঁও গভ. কলোনী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, খিলগাঁও সরকারি কলেজ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে শব্দের মানমাত্রা ৮৮ ডেসিবেলের ওপরে পাওয়া গেছে।
শব্দদূষণ সংক্রান্ত এই জরিপে রাজধানীর ১২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএএফ শাহীন কলেজ ও কিডস টিউটোরিয়াল স্কুলের সামনে শব্দের মাত্রা ছিল সর্বোচ্চ ১০০.৭৬ ডেসিবেল, যা আন্তর্জাতিক মানের প্রায় দ্বিগুণ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (৯৩.০৪ ডেসিবেল) এবং তৃতীয় স্থানে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ (৯২.৯২ ডেসিবেল)। এছাড়া ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, খিলগাঁও গভ. কলোনী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, খিলগাঁও সরকারি কলেজ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে শব্দের মানমাত্রা ৮৮ ডেসিবেলের ওপরে পাওয়া গেছে
রাজধানী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকায় শব্দের মাত্রা ছিল ৪১.২৪ ডেসিবল, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে নর্থ পয়েন্ট স্কুল ও কলেজ, সেখানের শব্দের মাত্রা ৬১.৪৪ ডেসিবল; তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে উদয়ন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেখানে শব্দের মাত্রা ৬৭.৭২ ডেসিবল। এছাড়া ঢাকা নেছারিয়া কামিল মাদরাসা, শ্যামপুর আইডিয়াল হাই স্কুল, ভূঁইয়া আইডিয়াল স্কুল, মেট্রোপলিটন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলক্ষেত কারিগরি কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক এবং শাহনূরী মডেল হাইস্কুলের সামনে শব্দের মানমাত্রা ৬৮ ডেসিবলের ওপরে পাওয়া গিয়েছে। গবেষণা বলছে, জরিপ করা এই ১২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে কম দূষিত নয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও দূষণের মাত্রা ছিল নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি।
‘নীরব এলাকা’র জন্য সরকারি আদর্শ মান দিনে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল হলেও ঢাকার প্রায় ৪৭টি স্কুল ও কলেজের সামনের শব্দমাত্রা ৮০ ডেসিবেলের বেশি। যা শ্রবণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপ, এমনকি হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
এক দিনও নির্মল বাতাসে শ্বাস নয়
একই প্রতিষ্ঠানের (ক্যাপস) ২০২৪ সালের বায়ুদূষণ গবেষণায় পাওয়া গেছে ভয়াবহ চিত্র। ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার নয় বছরের বায়ুমান সূচক (একিউআই) বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে শহরের মানুষ এক দিনও ভালো বা নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পারেননি। ওই মাসে ১৩ দিন বায়ু ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ও ১২ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের নভেম্বরে ঢাকার গড় বায়ুমান সূচক ১১ শতাংশ বেড়ে ১৯৫-এ পৌঁছেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার প্রায় তিনগুণ।
গবেষণায় দেখা যায়, ২০২২ ও ২০২৩ সালে দূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যার ধারাবাহিকতা ২০২৪ সালেও বজায় রয়েছে। ২০২১ সালের গড় বায়ুমান সূচক ছিল ১৫৯, ২০২২ সালে ১৬৩ এবং ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৭১-এ। ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাসের গড় সূচকও ছিল ১৬০, যা ‘অস্বাস্থ্যকর’ মাত্রার মধ্যেই পড়ে।
২০২০ সালে লকডাউনের সময় দূষণ কিছুটা কমে ১৪৫-এ নামলেও পরের বছরগুলোতে পরিস্থিতি আবারও অবনতি হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে বায়ুদূষণ সর্বাধিক হয়, অর্থাৎ গড়ে ২৫০ একিউআই; যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে পড়ে। অন্যদিকে, জুলাই ও আগস্ট মাসে গড় সূচক যথাক্রমে ৮৯ ও ৯৮, যা তুলনামূলক কম হলেও এখনও নিরাপদ নয়। গবেষণা অনুযায়ী, নভেম্বর, ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারি মাসগুলোতেও দূষণ বেশি থাকে। একিউআই গড়ে ১৭৭ থেকে ২২১ পর্যন্ত দাঁড়ায়।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকাবাসী এক দিনের জন্যও নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি বলে জানিয়েছে ক্যাপস। পুরো মাসে মাত্র এক দিন ছিল ‘মধ্যম’, চার দিন ‘সতর্কতামূলক’, ১২ দিন ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ১৩ দিন ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। ২০১৬–২০২৪ সালের ২৫৬ দিনের নভেম্বর মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৩৮ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৬৪ দিন ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’।
গবেষণায় বলা হয়, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস ঢাকার ইতিহাসে ‘দ্বিতীয় সর্বোচ্চ’ দূষিত মাস হিসেবে রেকর্ড হয়েছে, যা আগের বছরের নভেম্বরের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
আরও পড়ুন
বায়ুমানের বর্তমান প্রবণতা ও ঋতুভিত্তিক পরিবর্তন
পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের মতে, ঢাকা শহরের বায়ুমানের বর্তমান অবস্থা উদ্বেগজনক। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর থেকেই বায়ুমানের একটি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতি বছরই সাধারণত আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস থেকে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো অক্টোবর মাস থেকে বৃষ্টিপাত কমে আসে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার ফলে ধূলিকণাগুলো নিচে নামতে পারে না, যার কারণে দূষণ বেশি অনুভূত হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, দূষণের উৎসগুলো সবসময়ই মোটামুটিভাবে সক্রিয় থাকে; শুধুমাত্র বৃষ্টির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির উপরেই দূষণ অনুভূত হওয়া বা না হওয়াটা অনেকাংশে নির্ভর করে।
তার মতে, এই দূষণের উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহন। তিনি বলেন, “পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, মোট যানবাহনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হলো ফিটনেসবিহীন। সংখ্যায় এই ধরনের যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ। যখন ছয় থেকে সাত লাখ ফিটনেসবিহীন যানবাহন একত্রে বায়ুদূষণ করে, তখন অন্যান্য পদ্ধতিতে বায়ুদূষণ কমানোর আর কোনো সুযোগ থাকে না। যতক্ষণ না পর্যন্ত এই ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোকে ফেজ আউট করা যাচ্ছে, ততক্ষণ দূষণ কমানো সম্ভব নয়।
‘ঢাকা শহর বা শহরাঞ্চলে মোট বায়ুদূষণের প্রায় ১৫ থেকে ২০ ভাগ আসে এই ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে। এগুলো সরাসরি নগরজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আর এই দূষণের শিকার হচ্ছে সংবেদনশীল গোষ্ঠী— বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, গর্ভবতী মহিলা, অসুস্থ মানুষ ও শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ।’ ড. কামরুজ্জামান জোর দিয়ে বলেন, ‘ফার্মেসিগুলোতে ইনহেলার বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি এই দূষণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথম এবং এক নম্বর পদক্ষেপ হিসেবে এই ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোকে বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
কঠোর নীতিতে সরকারের শিথিলতা : এক ‘অশনি সংকেত’
ড. কামরুজ্জামান জানান, সরকার বিভিন্ন সময়ে ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে (যাদের অর্থনৈতিক জীবনচক্র শেষ হয়েছে, অর্থাৎ ২০ থেকে ২৫ বছর পুরোনো রিকন্ডিশন গাড়ি) ফেজ আউট করার ঘোষণা দিয়েছিল। ২০২৪ সালের জুলাই এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও জুলাইয়েও একাধিকবার পদক্ষেপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
তবে, আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে সরকারের সেই কঠোর বক্তব্যের শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে সেই উদ্যোগ আর চোখে পড়ছে না, যা একটি টেকসই পদক্ষেপ হতে পারত। বিশেষজ্ঞ ড. কামরুজ্জামানের মতে, এই শিথিলতা আগামী দিনগুলোর জন্য একটি অশনি সংকেত।
দেশের বরেণ্য এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এ সমস্যার দীর্ঘসূত্রতার কারণ হিসেবে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানে প্রশাসনিক এনফোর্সমেন্টের পাশাপাশি নাগরিক সম্পৃক্ততা এবং সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সরকার, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া— সব স্টেকহোল্ডারই এনফোর্সমেন্ট ও সামাজিক আন্দোলন, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে।
‘দূষণকারীদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে, ফলে সরকার একা উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল নাগরিকদের সহযোগিতা চাওয়া বা নাগরিক সম্পৃক্ততা তৈরি করা, কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। বিশেষ করে, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল, যেখানে প্রতি মাসে মিটিং করার কথা থাকলেও গত আট-নয় মাসে মাত্র দুটি মিটিং করা হয়েছে। এই মিটিংগুলোতে যে পরামর্শগুলো দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও বাস্তবায়িত বা প্রয়োগ করা হয়নি। এ কারণে বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ও টেকসই কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার নয় বছরের বায়ুমান সূচক (একিউআই) বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে শহরের মানুষ এক দিনও ভালো বা নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পারেননি। ওই মাসে ১৩ দিন বায়ু ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ও ১২ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের নভেম্বরে ঢাকার গড় বায়ুমান সূচক ১১ শতাংশ বেড়ে ১৯৫-এ পৌঁছেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার প্রায় তিনগুণ
বায়ু দূষণের ভয়াবহ মূল্য
অর্থনীতিবিদ সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে যে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব (সিগনিফিকেন্ট ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট) সৃষ্টি হচ্ছে, তার ফলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতির পরিমাণ হলো জিডিপির ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ পর্যন্ত।’ তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই ক্ষতির মূল কারণ দুটি। প্রথমত, স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধি (হায়ার হেলথকেয়ার এক্সপেন্ডিচার) এবং দ্বিতীয়ত, নাগরিকদের উৎপাদনশীলতা (প্রোডাক্টিভিটি) কমে যাওয়া। যখন মানুষের স্বাস্থ্য খারাপ থাকে, তখন তাদের নিজেদের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়; তার যে পরিমাণ কাজ করা দরকার বা যেভাবে কাজ করা দরকার, সেটা করতে পারে না।
‘শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতি নয়, এই পরিবেশ দূষণ জনস্বাস্থ্যেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বায়ুদূষণজনিত কারণে যে অসুখ-বিসুখ হচ্ছে, তার ফলে প্রতি বছর আনুমানিক লক্ষ লক্ষ কর্মদিবস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, দূষণের কারণে হওয়া স্বাস্থ্যঝুঁকির ফলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল (লাইফ এক্সপেক্টেন্সি) ৫.৪ বছর পর্যন্ত কমে যাচ্ছে।’
সৈয়দ আব্দুল হামিদ জানান, এই দূষণ শিশুদের প্রভাবিত করে, সাধারণ জনসংখ্যার (পপুলেশন) ক্ষতি করে এবং এমনকি সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের (অ্যাডাল্ট মানুষ) জীবনের আয়ুটাও শেষ করে দেয়। তিনি ঢাকার বর্তমান বায়ুর গুণগত মান সম্পর্কে তীব্র মন্তব্য করে বলেন, ‘এখানকার এয়ার কোয়ালিটির অবস্থা এতটাই খারাপ যে এটি বাসযোগ্য নয় (লিভেবল না), অর্থাৎ এই এয়ার কোয়ালিটিতে মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন।’
দূষণের দ্বিমুখী প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, দূষণের দুটি প্রধান উৎস। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ (ইনডোর এয়ার পলিউশন) এবং বাইরের উন্মুক্ত বায়ুদূষণ (এক্সটার্নাল এয়ার পলিউশন বা অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার পলিউশন)। ইনডোর পলিউশন মূলত ঘরের ভেতরে রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহৃত জ্বালানির সঙ্গে সম্পর্কিত। গ্রামগঞ্জে এখনও বাঁশের, খড় বা পাতা ব্যবহার করা হয়। যদিও বায়োগ্যাস বা অন্যান্য বিকল্প কুকিং ওয়ে ব্যবহার করে এই বিষয়ে কিছুটা কাজ হয়েছে, তবে এখনও পুরোপুরি অগ্রগতি হয়নি।
‘ঢাকা শহরের জন্য মূলত এক্সটার্নাল এয়ার পলিউশন বা অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার পলিউশনই প্রধান উদ্বেগের কারণ।’
আরও পড়ুন
ঢাকা শহরের দূষণের মূল কারণসমূহ
ঢাকা শহরের পরিবেশ দূষণের জন্য সৈয়দ আব্দুল হামিদ বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেছেন। এগুলো মূলত অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার পলিউশনের অংশ। এর মধ্যে অন্যতম হলো— সবুজায়নের অভাব ও পার্কের ক্ষতি। ঢাকা শহরে পরিকল্পিতভাবে গাছের অভাব রয়েছে। যতটুকু পার্ক আছে, সেগুলোকে দিনদিন নষ্ট করা হচ্ছে। এমনকি রোড ডিভাইডার বা আইল্যান্ডে যে গাছগুলো ছিল, মেট্রোরেল করার সময় তার একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন কোনো পরিকল্পিত পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে না।
‘সাভারসহ আশেপাশে প্রচুর ইটভাটা রয়েছে এবং সেই ইটভাটার এয়ারপোলিশন ঢাকা শহরে চলে আসে। এছাড়া, নির্মাণকাজের ধুলা একটা বড় কারণ। ঢাকা শহরে নিয়মিতই প্রচুর নির্মাণকাজ (কনস্ট্রাকশন) চলে। এই কাজের যে ধুলাবালি, তা বাতাসে মিশে সরাসরি মানুষের নাক, চোখ, মুখ ও ফুসফুসে ঢুকে যাচ্ছে। এছাড়া, দূষণের অন্যতম বড় কারণ হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এগুলোর চলাচলের কারণে কালো ধোঁয়া ও শব্দদূষণ হচ্ছে, যা বায়ুকে দূষিত করতে ব্যাপক অবদান রাখছে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকা দরকার, সেটি ঢাকা শহরে অনুপস্থিত।
পরিবেশ রক্ষায় জাতি হিসেবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি : পরিবেশ উপদেষ্টা
রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পরিবেশ উপদেষ্টা জাতিসংঘের পানি কনভেনশনে যোগ দিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থান করছেন।
তবে, সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে রাজধানীর দূষণ প্রসঙ্গে আফসোস প্রকাশ করে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় জাতি হিসেবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের অগ্রাধিকার প্রকৃতিকেন্দ্রিক বা প্রকৃতিবান্ধব হয়নি।’
‘যখন ১৮০টি দেশের মধ্যে আপনার পরিবেশগত কার্যক্ষমতার র্যাংক ১৭৯; তখন সেটাকে ৫০ পর্যন্ত এগিয়ে নেওয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। ১৭৯ থেকে ৫০, ৬০ বা ৭০-এ যাওয়া আসলেই খুব কঠিন। কিন্তু একবার আপনি এটিকে ৭০ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলে, সেখান থেকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব। আমরা এখন ১৭৯-এ আছি। এটা দেখায় যে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।’
টিআই/এমএআর/