বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছেন। প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম’র পরিচালিত গণনায় উঠে এসেছে।

বুধবার (১০ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে বাস্তুচ্যুত মানুষের এই সামগ্রিক সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

আইওএম জানিয়েছে, এই গণনাটি বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় কীভাবে মানুষের জীবনকে এখনও প্রভাবিত করছে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এই তথ্য বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন পরিকল্পনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গণনা অনুযায়ী,প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বর্তমানে ৪,৯৫৫,৫২৭ জন মানুষ দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ সময়ে ২৯ হাজারের বেশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতা (কী-ইনফরম্যান্ট) সাক্ষাৎকার এবং ৫,৩৮৮টি মাঠ পরিদর্শন সম্পন্ন হয়, যা বাংলাদেশে এই ধরনের গবেষণার মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্ববৃহৎ।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, দেশে প্রতি বছর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। তবে এতদিন পর্যন্ত এ ধরনের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির কোনো যাচাইকৃত জাতীয় তথ্য ছিল না। এই ঘাটতি পূরণে আইওএম দেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ৪,৫৭৯টি ইউনিয়ন, ৩২৯টি পৌরসভা ও ৪৮০টি সিটি কর্পোরেশন ওয়ার্ডে ব্যাপক গণনা পরিচালনা করেছে।

গণনা অনুযায়ী, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ (৬৩ শতাংশ) ২০২০ সালের এপ্রিলের আগেই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এক-চতুর্থাংশ মানুষ (২৫ শতাংশ) ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিলের মধ্যে নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

বিভাগভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ (১২.১ লাখ), এরপর ঢাকা (৭.৯ লাখ) এবং রাজশাহী (৬.৬ লাখ) বিভাগে।

মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের এক-চতুর্থাংশ চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, ভোলা ও নোয়াখালী চার জেলায় অবস্থান করছে। ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামীণ ইউনিয়ন এলাকায় বসবাস করছেন।

আইওএম বাংলাদেশের মিশন প্রধান ল্যান্স বোনো বলেন, বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা জানা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ফলাফল জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের কর্তৃপক্ষ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের আরও সুসংগঠিত পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা এই গণনাটিকে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনার জাতীয় কৌশল শক্তিশালী করার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন। এ ছাড়া, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আবদুল ওয়াদুদ; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ সাইফুল্লাহ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি ইভা আতানাসোভা বক্তব্য দেন।

অনুষ্ঠানে গণনা পদ্ধতি, প্রতিবেদন উন্মোচন এবং সরকারি ডেটা ব্যবস্থায় বাস্তুচ্যুতির তথ্য অন্তর্ভুক্তকরণ নিয়ে প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

উদ্যোগটির সহায়তাকারীরা বাংলাদেশকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির এই প্রথম জাতীয় গণনা দুর্যোগ প্রস্তুতি, পুনর্বাসন পরিকল্পনা, সামাজিক সুরক্ষা, জলবায়ু অভিযোজন এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নীতিনির্ধারকদের আরও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।

এনআই/এসএম