ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর প্রতিবাদ-বিক্ষোভের নামে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার ভবনে। ‘ডেইলি স্টার সেন্টার’ নামে এ ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত কিছুই আর অক্ষত নেই। জুলাই শহীদদের স্মরণে গড়া আলোকচিত্র গ্যালারি, কনফারেন্স রুম, নিউজরুম, ফটো ল্যাব, স্বৈরাচার আর্কাইভ থেকে শুরু করে আবু সাইদ ও মীর মুগ্ধের ছবিও আগুনে পুড়েছে। সব মিলিয়ে পুরো ভবন যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে অবস্থিত দ্য ডেইলি স্টার সেন্টার ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

পুড়েছে জুলাই শহীদদের আলোকচিত্র গ্যালারি

ভবনটির প্রথম তলায় ছিল জুলাই শহীদদের স্মরণে একটি বিশাল আলোকচিত্র গ্যালারি। ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অদম্য সাহস, দৃঢ়তা ও ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে সেই সময়ের আলোকচিত্র, ভিডিও ও সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে ‘৩৬ জুলাই : নির্ভীকদের অভিবাদন’ শীর্ষক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। সেই এক্সিবিশনে স্থান পাওয়া আলোকচিত্র ও এক্সিবিশন সেন্টারের সবকিছু পুড়েছে হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে।

জুলাই গণহত্যার পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জনমত গঠনের লক্ষ্যে এ ফটো গ্যালারি পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের। প্রদর্শনীতে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপি, ব্রিটিশ হাইকমিশনের মিনিস্টার কাউন্সেলর পলিটিক্যাল অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান গাভিন টেঞ্চসহ ১৬টির বেশি দেশের কূটনীতিকরা অংশ নেন। জুলাই শহীদদের স্মরণে নির্মিত সেই গ্যালারি এখন ছাই আর ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত।

মুছে গেছে ৯০ থেকে ২৪-এর স্বৈরাচার আর্কাইভ, পুড়েছে আবু সাইদ-মুগ্ধর ছবি

সরেজমিনে ঘুরে ও ডেইলি স্টারের একাধিক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেইলি স্টার সেন্টারে ছিল একটি স্বৈরাচারবিরোধী আর্কাইভ। এখানে সংরক্ষিত ছিল ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে করে ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের নানা তথ্য-প্রমাণ। 
এই আর্কাইভেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ডেইলি স্টারের সংবাদকর্মীরা। এতে আর্কাইভে থাকা সব তথ্য-প্রমাণ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। পাশাপাশি এই ভবনে ‘৩৬ জুলাই : নির্ভীকদের অভিবাদন’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে আবু সাইদ ও মুগ্ধের যে ছবি ছিল সেখানেও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। রেহাই পায়নি আবু সাইদ ও মুগ্ধসহ জুলাই শহীদদের নিয়ে আঁকা চিত্রকর্মও।

কোন তলায় কী ছিল?

ডেইলি স্টারে কর্মরত একাধিক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবনটির গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ প্রথম তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত পুরোপুরি পুড়ে গেছে। পঞ্চম থেকে ৬ষ্ঠ তলার সবকিছু না পুড়লেও ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে। মনিটর, ক্যামেরা, টেলিভিশন, সিপিইউ, গুরুত্বপূর্ণ নথি কিছুই আর অক্ষত নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারের এক সাংবাদিক বলেন, ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিল অভ্যর্থনা কক্ষ, প্রথম তলায় ছিল জুলাই শহীদদের গ্যালারি। দ্বিতীয় তলায় ছিল স্টোর রুম, তৃতীয় তলায় কনফারেন্স রুম, চতুর্থ তলায় ক্যান্টিন, পঞ্চম তলায় বিজনেস ডেভলপমেন্ট টিমের অফিস এবং ষষ্ঠ তলায় ছিল নিউজরুম। এসবের কিছুই আর আগের মতো নেই। হয় পুড়ে গেছে না হয় ভাঙচুরে বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে।

পুড়েছে ডেইলি স্টার, পুড়েছে প্রবীরের স্বপ্ন

বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে ডেইলি স্টার ভবনে থাকা সব সরঞ্জামের পাশাপাশি পুড়ে গেছে পত্রিকাটির ফটো সাংবাদিক প্রবীর দাশের স্বপ্নও। দীর্ঘদিন ধরে তোলা তার নানা গুরুত্বপূর্ণ ছবি নিয়ে চারটি হার্ডডিস্ক ছিল। এসব হার্ডডিস্কে তিনি সারা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও দুর্লভ ছবিগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু সেগুলোর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এ ছাড়া তার ডেস্কে বেশকিছু নগদ টাকাও রাখা ছিল, সেগুলোও নিয়ে গেছে হামলা ও লুটপাটকারীরা।

কথা হয় ফটো সাংবাদিক প্রবীর দাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার নিজের বলতে আর কিছুই নেই। সারা জীবন যত ছবি তুলেছি তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমার ডেস্কের একটি সুতাও আর অবশিষ্ট নেই। আমার সকল ডকুমেন্টস, পাসপোর্ট, গুরুত্বপূর্ণ নথি সবকিছু অফিসে ছিল। আমরা বাসার চেয়েও অফিসকে বেশি নিরাপদ মনে করতাম। কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’

এই ফটো সাংবাদিক বলেন, ‘এ ভবনের প্রথম থেকে ছয় তলা পর্যন্ত সব জায়গাতেই অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছে। সকালে এসে আমি উপরে গিয়েছি, ঘুরে দেখেছি। আমার ক্যামেরা থেকে শুরু করে কিছুই নেই। আমার সারা জীবনের সংগ্রাম আর স্বপ্ন সবকিছু এখন শুধুই ছাই’।

ভেতরে আটকা পড়েছিলেন ২৮ সাংবাদিক

বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে আগুন দেওয়ার পর ডেইলি স্টার ভবনে আটকা পড়েন ২৮ জন সাংবাদিক। নিচের ফ্লোরগুলোতে অগ্নিসংযোগ করার পর তারা ভবনের ছাদে আশ্রয় নেন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় তাদের উদ্ধার করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পত্রিকাটির এক সাংবাদিক বলেন, গতকাল আগুনের ঘটনায় আমাদের ২৮ জন সহকর্মী ভেতরে আটকা পড়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন প্রচুর শ্বাসকষ্টে ভুগছেন।
ভয়াবহ আগুনে নিজের শিক্ষাজীবনের সব সনদ পুড়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন ডেইলি স্টারে কর্মরত এক সাংবাদিক। পাশাপাশি গতকাল (বৃহস্পতিবার) কেনা তার বেশকিছু নতুন বইও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব বইয়ের কিছু অংশ বিচ্ছিন্নভাবে ডেইলি স্টার ভবনে এখনো দেখা যাচ্ছে।

‘ব্লাক আউটের দিনে তাকিয়ে থাকতাম ডেইলি স্টারে’

ভয়াবহ এ অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ডেইলি স্টার সেন্টারের সামনে ভিড় জমিয়েছে উৎসুক জনতা। ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারী মুনতাসির ফুয়াদ বলেন, যখন হাসিনা সরকার ইন্টারনেট ব্লাক আউট করেছিল তখন আমরা ডেইলি স্টারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, প্রথম আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কয়জন শহীদ হলেন, সর্বশেষ শহীদের সংখ্যা কত হলো- এসব দেখতে ডেইলি স্টার দেখতাম। সেসময় অনলাইন কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনে খবর পেতাম না।

ডেইলি স্টারও পুলিশের ‘ক্রাইম সিন’

এদিকে, ডেইলি স্টারের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ক্রাইম সিন ঘোষণা করেছে। ‘ডু নট ক্রস’ লেখা ফিতা টানিয়ে সীমিত করা হয়েছে জনসাধারণের প্রবেশ। পুলিশের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘ক্রাইম সিন’ লিখে বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখার অর্থ হচ্ছে, ওই বেষ্টনী পেরিয়ে কেউ কার্যালয়ে প্রবেশ করতে বা বের হতে পারবে না। অপরাধ তদন্তের জন্য সেখান থেকে পুলিশ আলামত সংগ্রহ করছে। তদন্তের এ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পত্রিকাটির কার্যালয় কার্যত বন্ধ থাকবে।
এ বিষয়ে পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সিআইডি থেকে ভবনটিকে (ডেইলি স্টার সেন্টার) ক্রাইম সিন ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এ এলাকাটি পুরো কর্ডন করে দেব। এখানে আর প্রবেশের সুযোগ নেই। আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করেছি। আমাদের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদসরাও দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে, ডেইলি স্টার সেন্টারের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি নাগরিক সমাজের

ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বলেন, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনায় আমরা নিন্দা জানাই। দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এ হামলা চালানো হয়েছে, এটি পূর্বপরিকল্পিত। আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানারকম খেলা চলছে। তাই দয়া করে আইন হাতে তুলে নেবেন না কেউ।

তিনি আরও বলেন, ১২ ডিসেম্বর ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূল অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। এত দিনেও অপরাধীদের ধরা হয়নি। উল্টো ভিন্ন মানুষকে ধরা হচ্ছে। এ নিয়ে নানা ধরনের খামখেয়ালি দেখতে পাচ্ছি আমরা, যা রাষ্ট্রের কাছে আশা করি না। অতএব এ দায় নিয়ে আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছি।

ফোনালাপে পাশে থাকার আশ্বাস প্রধান উপদেষ্টার

প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় পত্রিকা দুটির সম্পাদকদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের প্রতিষ্ঠান ও সংবাদকর্মীদের ওপর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও ন্যক্কারজনক হামলা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। আপনাদের এই দুঃসময়ে সরকার আপনাদের পাশে আছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশের শীর্ষ স্থানীয় দুটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর এ হামলা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলার শামিল। এ ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে এক বিরাট বাধা সৃষ্টি করেছে।

শুক্রবার প্রকাশিত হয়নি ডেইলি স্টার

হামলার কারণে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুক্রবার প্রকাশিত হয়নি দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকা। প্রকাশনা কার্যক্রম সাময়িকভাবে ব্যাহত হওয়ায় তাদের ফেসবুক পেজে বিষয়টি জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ। এক নোটিশে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ‘গত রাতে আমাদের অফিসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর দ্য ডেইলি স্টারের প্রকাশনা কার্যক্রম সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এজন্য আমরা আমাদের পাঠকদের কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি এবং অনলাইন সেবা ও প্রকাশনার কাজে আমরা যতক্ষণ নিয়োজিত থাকব, ততক্ষণ আপনাদের ধৈর্য ও সহযোগিতা কামনা করছি।’

এমএম/এসএসএইচ