বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন আমীর মো. আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে নাবিক নিয়োগে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি এবং বেতন বৈষম্য, শ্রম আইন লঙ্ঘন ও নাবিকদের হয়রানিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদন্তে এসবের সত্যতা মিললেও রহস্যজনকভাবে বিএসসি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে নাবিক ও কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

এ ছাড়া সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির মতো গুরুতর অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে ওই কমিটি তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করেছে।

জানা গেছে, গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের সী-ম্যান্স অ্যাসোসিয়েশন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের কাছে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে নানা বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগ পাওয়ার পর ওই বছরের ৩ অক্টোবর বিএসসি শাখা কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন উপদেষ্টা। এরপর ১৬ অক্টোবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বিএসসির মহাব্যবস্থাপক মো. আতাউর রহমানকে সভাপতি, মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন মো. মুজিবুর রহমানকে সদস্য ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক শামীম আহমেদকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে বলা হয়।

তদন্ত কমিটি দুই দফায় আবু সুফিয়ানকে তাদের সামনে উপস্থিত হতে বললেও তিনি তা অগ্রাহ্য করেন। এ ছাড়া তদন্তের স্বার্থে জাহাজ বহরের বিগত পাঁচ বছরের ক্রু লিস্ট সরবরাহের অনুরোধও তিনি উপেক্ষা করেন।

গত ৮ জানুয়ারি দেওয়া কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবু সুফিয়ানের এমন আচরণ তদন্ত কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করেছে। এ কারণে কমিটির সুপারিশে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তা তদন্ত কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করেছেন। বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে।

তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং কমিটির সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও ১১ মাসের বেশি সময় অতিক্রম হওয়ার পরও বিএসসি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আবু সুফিয়ান স্থায়ী নাবিকদের বাদ দিয়ে নিজের পছন্দমতো চুক্তিভিত্তিক অফিসার ও সাধারণ নাবিক নিয়োগ দিয়েছেন। অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়া তিন নাবিক অতীতে বিদেশে গিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। যে কারণে মেরিন সেক্টরে বিএসসির সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়। পালানো নাবিকরা আবু সুফিয়ানের কাছের হওয়ায় ওই সময় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বেতন বৈষম্য সৃষ্টি, নাবিকদের অফিসে হয়রানি, শ্রম আইনের লঙ্ঘন করে চুক্তি সম্পাদন এবং নিজের স্বজনদের জাহাজে পাঠিয়ে সুবিধা নিশ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিএসসি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আবু সুফিয়ান ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। এ কারণে পুরো সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নাবিকরা তার ওপর ক্ষুব্ধ।

বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (শিপ পার্সোনেল) মেরিন ইঞ্জি. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরি বলেন, নাবিক পালানোর ঘটনায় ওই সময় ব্যবস্থা না নেওয়া হলেও আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বন্ড মানি (সিকিউরিটি) আদায়ে মামলা করেছি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বিএসসির মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন আমীর মো. আবু সুফিয়ান বলেন, আমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ তোলা হয়েছে সব ভিত্তিহীন। আমার কাছে সব ডকুমেন্টস রয়েছে।

এ বিষয়ে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেন, তাকে ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত কঠোর তত্ত্বাবধানে রেখেছে। শিপ পার্সোনেল বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে তাকে ডেজিগনেটেড পারসন এশোর অ্যান্ড কোম্পানি সিকিউরিটি অফিসার (ডিপিএ অ্যান্ড সিএসও) পদে দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে।

এদিকে, আবু সুফিয়ানের এসব অনিয়মের অভিযোগ গেছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)। তারা ইতোমধ্যে অভিযানের মাধ্যমে অভিযোগগুলো যাচাই শুরু করেছে। প্রাথমিক পর্যালোচনায় বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে এবং অভিযানের সময় যাবতীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, বিএসসি কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আমীর মো. আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তদন্ত চলমান আছে। তদন্তাধীন বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে পারব না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের সদস্য অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া উদ্বেগজনক ও অগ্রহণযোগ্য। নাবিক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, শ্রম আইন লঙ্ঘন, নাবিকদের হয়রানি ও সনদ জালিয়াতির মতো গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের নীরবতা প্রমাণ করে, এখানে জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে।

এমআর/এসএসএইচ