বরফ পড়লে কোথায় থাকে এই প্রাণী?
আর্কটিক অঞ্চল মানেই চারপাশ জুড়ে বরফ, তীব্র ঠান্ডা এবং প্রায় নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখানে বেঁচে থাকা কোনও প্রাণীর পক্ষেই সহজ নয়। বছরের অধিকাংশ সময় তাপমাত্রা শূন্যের অনেক নিচে থাকে, গাছপালা খুব কম এবং খোলা তুন্দ্রা প্রান্তরে লুকিয়ে থাকার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
এই কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য আর্কটিক অঞ্চলের প্রাণীরা হাজার হাজার বছর ধরে বিশেষ ধরনের অভিযোজন ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ক্যামোফ্লাজ বা পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে এমনভাবে মিশিয়ে নেওয়া, যাতে শিকারি কিংবা শত্রুর চোখে পড়তে না হয়।
বিজ্ঞাপন
এই বরফের রাজ্যে ক্যামোফ্লাজ শুধু আত্মরক্ষার কৌশল নয়, বরং জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দেয়। আর্কটিক ফক্স এই অভিযোজন ক্ষমতার অন্যতম সেরা উদাহরণ। শীতকালে এই শিয়ালের লোম সম্পূর্ণ সাদা হয়ে যায়, যা বরফে ঢাকা তুন্দ্রার সঙ্গে একেবারে মিশে যায়। দূর থেকে তাকে আলাদা করে চেনাই প্রায় অসম্ভব। এর ফলে বড় শিকারির হাত থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং একইসঙ্গে ছোট প্রাণী শিকার করাও তার পক্ষে সহজ হয়।
গ্রীষ্ম এলে বরফ গলে মাটি ও পাথর বেরিয়ে পড়ে, তখন আবার তার লোম বাদামি বা ধূসর রঙের হয়ে যায়। ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে এই রঙ বদলের ক্ষমতা আর্কটিক ফক্সকে বছরের সব সময়েই নিরাপদ রাখে।
বিজ্ঞাপন
শুধু লোমের রং নয়, আর্কটিক ফক্সের ঘন পশমও তার বেঁচে থাকার বড় অস্ত্র। এই পশম –৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও শরীরের তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে তীব্র ঠান্ডার মধ্যেও সে সক্রিয় থাকতে পারে। বরফের মধ্যে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার এই ক্ষমতাই তাকে আর্কটিক অঞ্চলের সবচেয়ে সফল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম করে তুলেছে।
আকাশে উড়ে বেড়ানো এক অনন্য ক্যামোফ্লাজ বিশেষজ্ঞ হলো স্নোই আউল। এই পেঁচার শরীরের রং এতটাই সাদা যে বরফে ঢাকা জমিতে বসে থাকলে তাকে চেনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ স্নোই আউল প্রায় পুরোপুরি সাদা হয়। স্ত্রী পেঁচা ও কমবয়সি পেঁচার গায়ে কিছু কালচে দাগ থাকে, যা বরফ ও পাথরে ভরা অসমতল জমিতে লুকিয়ে থাকার জন্য উপযোগী। এই রঙের কারণেই তারা নিঃশব্দে লেমিং বা অন্যান্য ছোট প্রাণীর কাছে পৌঁছে যেতে পারে।
স্নোই আউলের ক্যামোফ্লাজ শুধু শিকারের সময় কাজে লাগে না, বাসা বাঁধার সময়ও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরা সাধারণত খোলা মাটিতেই বাসা বানায়, যেখানে গাছ বা ঝোপঝাড়ের আড়াল নেই। সাদা রঙ তাদের ডিম ও ছানাদের শত্রুর চোখ থেকে আড়াল করে রাখে। ফলে প্রাকৃতিক শত্রুর আক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
মাটির কাছাকাছি বসবাসকারী আরেকটি চমকপ্রদ প্রাণী হলো আর্কটিক হেয়ার। বিশাল খোলা তুন্দ্রা অঞ্চলে এই খরগোশ জাতীয় প্রাণীর লুকিয়ে থাকার জায়গা খুবই কম। তাই শীতকালে তাদের লোম একেবারে সাদা হয়ে যায়, যাতে সে বরফের সঙ্গে মিশে থাকতে পারে। গ্রীষ্মকালে আবার লোমের রং বদলে বাদামি বা ধূসর হয়ে যায়, যা খোলা জমির সঙ্গে মানানসই। এই রঙ বদলই তার প্রধান আত্মরক্ষার কৌশল।
আর্কটিক হেয়ার সাধারণত দলবদ্ধভাবে থাকে। বিপদের সময় তারা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে দৌড়াতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ক্যামোফ্লাজ শত্রুকে বিভ্রান্ত করে রাখে। শিকারি অনেক কাছাকাছি চলে আসার আগেও তাদের আলাদা করে চেনা যায় না, যা তাদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময় এনে দেয়।
এই সব উদাহরণ থেকে বোঝা যায় কেন আর্কটিক অঞ্চলে ক্যামোফ্লাজ এতটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে গাছপালা বা ঘন বন নেই, যেখানে প্রাণীরা লুকোতে পারে। খোলা বরফের প্রান্তরে রঙের মাধ্যমেই নিজেদের আড়াল করতে হয়। এতে শুধু শক্তি সাশ্রয়ই হয় না, অপ্রয়োজনীয় সংঘর্ষও এড়ানো যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা
তবে বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এই প্রাকৃতিক অভিযোজনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। শীতের সময় কমে যাওয়া এবং বরফের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে সাদা লোমওয়ালা প্রাণীরা এখন অনেক সময় গাঢ় রঙের জমিতে বেশি দৃশ্যমান হয়ে পড়ছে। এর ফলে শিকারির আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে এবং তাদের টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। প্রকৃতির এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে ভবিষ্যতে আর্কটিক অঞ্চলের এই অনন্য প্রাণীদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে।
এসএম