রিকশাচালক মোবারক হোসেন। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী হলেও গত ২৫ বছর ধরে তিনি মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার বাসিন্দা। আগে ব্যবসা করতেন। দোকানে দোকানে ঘুরে কয়েল সাপ্লাই করতেন। লকডাউনে অধিকাংশ দোকান বন্ধ থাকায় এখন রিকশা চালিয়ে সংসার চালান।

বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) রাজধানীর রাসেল স্কয়ার মোড়ে কথা হয় মোবারক হোসেন সঙ্গে। পরিশ্রান্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আগে দোকানে দোকানে কয়েল সাপ্লাই দিতাম। তা দিয়েই পরিবার চলত। লকডাউনের কারণে অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। জমানো টাকাও নাই। তাই এখন বাধ্য হয়ে রিকশা নিয়ে নেমেছি। সেটাও চালাতে পারি না। সব মিলে খুব কষ্টে আছি।’

তিনি বলেন, ‘এতদিন ধরে ঢাকায় থাকি, কিন্তু কখনো এমন খারাপ অবস্থা হয়নি। অভাব-অনটন আগেও ছিল, কিন্তু এতটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় নাই। গত লকডাউনে জমানো কিছু টাকা পয়সা ছিল যার কারণে তেমন সমস্যা হয়নি। এবার খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে।’

একই ধরনের অভিব্যক্তি জানালেন পাশের রিকশাচালক বাদল মিয়া। দৈনিক ১২০ টাকা জমা ভিত্তিতে রাজধানীর তেজকুনি পাড়ার একটি গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা পর্যন্ত রিকশা চালান তিনি। বললেন, লকডাউনের আগে মানুষজন বেশি থাকায় যাত্রী বেশি পাওয়া যেত। যার কারণে দৈনিক জমা খরচ ও নিজের খাবার খরচের পরও কিছু টাকা থাকত। কিন্তু এখন সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

শুধু মোবারক হোসেন কিংবা বাদল মিয়াই নন। এবারের লকডাউনে কাজ হারানো অসংখ্য মানুষকে দৈনন্দিন নানা কষ্ট আর যাতনা মাথায় নিয়েই কাটাতে হচ্ছে অনিশ্চিত জীবন।

রাজধানীর পান্থপথ ও শুক্রাবাদ এলাকায় রিকশাচালক ও নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে করোনাকালীন সময়ে তাদের যাপিত জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে অধিকাংশই জানান নিজেদের অসহায়ত্বের কথা। যদিও লকডাউনের মাঝেও আয়ের আশায় গ্রাম ছেড়ে রাজধানীতে এসেছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়।

আয়ের আশায় রাজধানীতে আসা এমনই একজন মো. আনোয়ার হোসেন। তার বাড়ি বগুড়ার ধুনট এলাকায়। গ্রামে দিনমজুরের কাজ করলেও এখন লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ। তাই এই বিধিনিষেধের মাঝেই বগুড়া থেকে আম ও সবজিবাহী ট্রাক-পিকআপে চড়ে জীবিকার খোঁজে ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে ফেরত গিয়েছেন তার সঙ্গে আসা কয়েকজন। গত তিনদিন ধরে মোহাম্মদপুরের একটি গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে বের হচ্ছেন আনোয়ার। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে গ্যারেজেই।

আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনদিন ধইরা ঢাকা শহরে আছি। এই কয়দিনে ইনকাম হয়েছে মাত্র এক হাজার টাকা। জমা খরচ আছে, খাবার খরচ আছে, থাকার খরচ আছে। বাড়িতে পরিবার আছে, তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেবলমাত্র বাড়িতে দিয়েছি ৩০০ টাকা। কেমনে চলবো?

বেকায়দায় পড়েছেন ফুটপাতের ভাসমান দোকানিরাও। শুক্রাবাদ মোড়ের তালাচাবির মেকানিক সুমন মিয়া  বলেন, লকডাউনের কারণে পুলিশের কড়াকড়িতে দোকান খুলতে পারছি না। অথচ আমার জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে এই দোকান। পরিবার পরিজন যে নিয়ে কী অসহনীয় কষ্টের মধ্যে রয়েছি সেটি বলে বোঝানোর মত নয়।

পাশেই ফ্লাক্সে চা নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় ১০ বছরের শিশু মারুফকে। ১০ বছর বয়সী মারুফ জানায়, লকডাউনের কারণে বিধিনিষেধ থাকায় পুলিশের ভয়ে বাবা ফুটপাতে বসতে পারছে না। তাই সংসারের খরচ যোগাতে নিজেকেই চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে বের হতে হয়েছে। প্রত্যাশা, ছোট মানুষ বিবেচনায় হয়তো পুলিশ ধরবে না।

মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ১ জুলাই থেকে সারাদেশে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়। এটি গত বুধবার (৭ জুলাই) মধ্যরাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকার কথা থাকলেও সংক্রমণ না কমায় যা পুনরায় বাড়ানো হয়েছে। বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে এই সময়ে মানুষের সার্বিক কার্যাবলী ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

আরএইচটি/এমএইচএস