সেজান জুসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে (সেজান জুসের কারখানা) অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় বিভিন্ন সংগঠন শোক জানিয়েছে। একই সঙ্গে অনেক সংগঠন ক্ষোভও জানিয়েছে। 

শুক্রবার (৯ জুলাই) বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ক্ষোভ জানানো হয়। পাশাপাশি শোক বার্তায় শোক জানানো হয়। এছাড়া, সংগঠনগুলো আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুযায়ী নিহতদের আজীবন আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী (ভারপ্রাপ্ত) আবুল হাসান রুবেল এক যৌথ বিবৃতিতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লেগে ৫০ জনের অধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগুনে পুড়ে শ্রমিক হত্যার দায় রাষ্ট্র ও সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। অগ্নিকাণ্ডে এতগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর জানা গেল, এ কারখানা ও ভবনের নকশা অনুমোদনে ত্রুটি ছিল। এ ধরনের ত্রুটি চিহ্নিত করা এবং শ্রমিক কর্মচারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও তার অধীনে নানা সংস্থা ও লোকবল আছে। দুর্ঘটনা ঘটার আগেই তা চিহ্নিত করা এবং প্রতিকারের জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্বও আছে; কিন্তু তাদের কাজের কোনো জবাবদিহিতা নেই; নেই দায়িত্বে অবহেলার জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা। ফলে এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটেই চলেছে।

খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসাইন এক শোক বার্তায় বলেছেন, মহান আল্লাহর নিকট নিহত সবার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। জানা গেছে, হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানাতে হতাহতদের অনেকেই শিশু। শ্রম আইন লঙ্ঘন করে শিশুদের এভাবে কাজে লাগানো, অনিরাপদ পরিবেশে কারখানা প্রতিষ্ঠাসহ অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা দ্রুত সময়ে তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। দেশে ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ডের দায় প্রশাসন কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের নজরদারির অবহেলায় বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) উপ-পরিচালক মাহবুবা আক্তার এক বিবৃতিতে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে বহু শ্রমিকের হতাহতের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত, দায়ীদের বিচার ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করছে ব্লাস্ট। ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন বলে গণমাধ্যম সূত্র থেকে জানা গেছে। 

অভিযোগ রয়েছে যে, কারখানার সিঁড়ি বন্ধ থাকায় লাফিয়ে পড়ে নারী শ্রমিকসহ অনেকের মৃত্যু হয়েছে। আমরা এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের দ্রুত বিচার এবং শাস্তি দাবি করছি। পাশাপাশি আমরা নিহত ও আহতসহ ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাসহ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তার দাবি জানাচ্ছি।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন ও সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব বুলবুল এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ছয়তলা কারখানা ভবনে উৎপাদনের কার্যক্রম চালু থাকা অবস্থায় গতকাল বিকেলে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। শ্রমিকদের ভাষ্য অনুসারে অগ্নিকাণ্ডের সময় এক হাজারের অধিক শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম প্রাথমিকভাবে স্বপ্না রাণী, মিনা আক্তার ও মোরসালিন নামে তিনজন শ্রমিক নিহত, ৭০ জন শ্রমিক নিখোঁজ থাকার সংবাদ প্রচারিত হলেও পরবর্তী সময়ে অর্ধশতাধিক মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। সব নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারকে আইএলও কনভেনশন ১২১ বিবেচনায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহত শ্রমিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি মো. ফয়েজ উল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল এক যৌথ বিবৃতিতে নিহত শ্রমিকদের প্রতি গভীর শোক জানান। তারা বলেন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ ঘটনা আমাদের ভেতর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘ ২১ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আমরা জেনেছি, ফায়ার সার্ভিস সেখানে যথাসময়ে উপস্থিত হতে পারেনি। আগুন নেভাতে দেরি হওয়ার জের ধরে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কারখানাটিতে কোনো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ছিল না বলে দাবি করেছেন শ্রমিকেরা।

এছাড়াও তারা দাবি করছেন, আগুন লাগার পরও ভবনটির চতুর্থ তলার গেট তালাবদ্ধ ছিল বিধায় চতুর্থ তলায় কর্মরত কোনো শ্রমিক বের হয়ে আসতে পারেননি। কারখানাটিতে ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক কাজ করতেন বলে জানা যায়। এটিকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে। আমরা প্রায়শই দেখি, দেশের কারখানাগুলো যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হয় না। কারখানা মালিকের অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র না থাকা এবং জরুরি বহির্গমন ব্যবস্থা না থাকায় এতগুলো শ্রমিককে প্রাণ দিতে হলো। শ্রমিকদের মৃত্যুর দায় অবশ্যই কারখানা মালিক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাবিবুল্লাহ বাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম এক যৌথ বিবৃতিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একের পর এক অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধসের ঘটনায় অকাতরে হাজার হাজার শ্রমিকের তাজা প্রাণ ঝরে গেলেও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয়নি। এমনকি অগ্নিকাণ্ডের দায়ে কোনো বিচার পর্যন্ত হয়নি, যার কারণে মালিকদের বেপরোয়া শোষণের বলি হতে হয় শ্রমিকদের। অথচ প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি গঠন এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা রকম আলোচনা হলেও কিছুদিন পর তা থেমে যায় এবং শ্রমিকদের অনিরাপদ পরিবেশেই জীবিকার তাগিদে জীবনকে তুচ্ছ করে কাজ করতে হয়।

তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, কারখানা থেকে বের হওয়ার গেটে তালা বন্ধ করে রাখায় এবং অগ্নিনির্বাপণের প্রাথমিক ব্যবস্থা না থাকায় এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তাই এ অগ্নিকাণ্ড বা ভবনধস নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুল্য। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের জন্য মালিকদের পাশাপাশি সরকারও এর দায় এড়াতে পারে না। ওই ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী সব শ্রমিকদের এক জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান, অগ্নিকাণ্ডের বিচারবিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দায়ী সব পক্ষের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, অনুমোদনহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়া এবং সকল শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) যুগ্ম সমন্বয়কারী শহিদুল্লাহ চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেন, বর্ষাকালে এরূপ নিয়ন্ত্রণহীন অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করে কারখানাটিতে অগ্নিনিরোধের ন্যূনতম আয়োজন ছিল না। দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ এবং কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপনাতেও ছিল না আইনের বাস্তবায়ন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু অব্যবস্থাপনারই চরম নিদর্শন। আর অব্যবস্থাপনার দায় সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরসমূহও এড়াতে পারে না। শিল্প দুর্ঘটনা বন্ধ করতেই শ্রম আইনের ১৫১ নম্বর ধারা এবং পঞ্চম তফসিলকে আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুসারে সংশোধন করতে হবে। নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবার প্রতি আজীবন আয়ের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য তাৎক্ষণিক সহায়তা, বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কামরুল আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আমিরুল হক আমিন শোক প্রকাশ করে বলেন, কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে শত শত শ্রমিকের হতাহতের ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। করোনা মহামারির কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সরকার শিল্পকারখানা চালু রাখতে শ্রমিকদের বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত রেখে মালিকদের শ্রমিকের কাজে যোগদানে তাদের যাতায়াতে পরিবহন ও স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিপত্র জারি করেছিল। কিন্তু মালিকরা এ ঘোষণা অনুসরণ করেননি।

সেজান জুস কারখানার অগ্নিকাণ্ড তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। নিরাপদ কর্ম পরিবেশ শ্রমিকের মৌলিক অধিকার। প্রতিষ্ঠানের মালিককেই তা নিশ্চিত করা আইনের বাধ্যবাধকতা। হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের সেজান জুস কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকের নিরাপদ কর্মপরিবেশ রক্ষায় উদাসীন ছিল। তাই শ্রমিককে লাশ বানানো ও আহত করার দায় তাদেরই নিতে হবে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ, পরিপূর্ণ ও শোভন স্বাস্থ্যসেবার অধিকার; মৌলিক মানবিক অধিকার সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। ওই অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিকদের উপযুক্ত ও পরিপূর্ণ চিকিৎসা ও নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ এবং জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের প্রতি গভীর শোক এবং উদ্বেগ জানিয়েছেন। আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুযায়ী নিহতদের আজীবন আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন তারা।

এছাড়াও, একই দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

এমএইচএন/আরএইচ