পেশায় তিনি একজন গৃহিণী। আয় বলতে নেই কোনো স্বীকৃত উৎস। তারপরও রাজধানীর শান্তিনগরে আড়াই হাজার বর্গফুট ও কক্সবাজারের রিসোর্টে ৪৭৫ বর্গফুট ফ্ল্যাটের মালিক। রয়েছে ৭০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও টয়োটা গাড়ি।

কোটি কোটি টাকার এসব সম্পদের মালিক শরীফা বেগম মনি। তিনি পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেসুর রহমানের স্ত্রী।

যদিও নিজের নামে উল্লেখযোগ্য সম্পদ গড়তে পারেননি মোখলেসুর রহমান। কাগজ-কলমে অর্ধকোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক তিনি।  

নিজের ও স্ত্রীর নামে সম্পদের বৈধতা পেতে আয়ের উৎস দেখিয়েছেন, নারীদের পোশাক বিক্রি, সঞ্চয়পত্রের সুদ, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, আগের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরির বেতন, উত্তরাধিকার এবং লন্ডনে কর্মরত ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ।

স্বামী-স্ত্রীর বৈধ-অবৈধ সম্পদের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদের সত্যতা পাওয়ায় রাজশাহীর সারদায় পুলিশ একাডেমিতে কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেসুর রহমান ও তার কোটিপতি স্ত্রীর কাছে সম্পদের হিসাব চান দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক শাহীন আরা মমতাজ।

স্ত্রীর নামে যত সম্পদের বিবরণী পাওয়া গেছে সবই প্রকৃতপক্ষে মোখলেসুর রহমানের। কারণ, তিনি সব সম্পদের মালিক হয়েছেন বিয়ের পর। এছাড়া দুদকের অনুসন্ধানে আরও সম্পদের খোঁজ মিলেছে।

দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা

সম্প্রতি মোখলেসুর দম্পতি সম্পদের বিবরণ দুদক সচিবের কাছে জমা দিয়েছেন। দুদক উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক তাদের সম্পদের তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন।   

এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেসুর রহমানের অফিসিয়াল ফোন নম্বরে কয়েকবার কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

দুদক পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাই করতে একজন উপ-পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান শেষ হলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।

মোখলেসুর ও মনি দম্পতির বিষয়ে দুদকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মোখলেসুর রহমান ১৯৯৫ সালে নেত্রকোনার ফজলুর রহমান ও হোসনে আরা বেগমের মেয়ে শরীফা বেগম মনিকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। ছেলে মুনতাসির রহমান মুঞ্জ খুলনা প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মেয়ে মাইশা বাশিদা মাইমা ভিকারুননিসা কলেজে পড়েন। স্ত্রী শরীফা বেগম মনি একজন গৃহিণী। তার স্বামী-স্ত্রী দুজনই আয়কর দাতা। স্ত্রী মনি ২০০৮ সাল আয়কর নথি চালু করেন। আর মোখলেসুরের আয়কর নথি চালু হয় ৯০ দশকে।

দুদকের অনুসন্ধানে অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেসুর রহমানের নামে ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৬ টাকার স্থাবর এবং ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৩ টাকার অস্থাবরসহ মোটি ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। অন্যদিকে তার স্ত্রী মনির নামে এক কোটি ৪৪ লাখ ১৩ হাজার টাকার স্থাবর এবং এক কোটি ১৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৮০ টাকার অস্থাবরসহ মোট ২ কোটি ৫৮ হাজার ৭ হাজার টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে তাদের নামে ৩ কোটি ১৮ লাখ সাড়ে তিন হাজার টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে।

যদিও টাকার হিসাব শুধু দালিলিক সংখ্যা ধরেই বের করা হয়েছে। বাস্তবে তাদের নামে থাকা সম্পদের মূল্য কয়েকগুণ বেশি বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ অর্থনীতিসহ সবক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের এই অগ্রযাত্রায় সবক্ষেত্রেই শুদ্ধতা দরকার। আমরা চেষ্টা করছি, আগে নিজেদের ঘরকে শুদ্ধ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্পদের যে বিবরণী কাগজপত্রে পাওয়া গেছে তা মোখলেসুর রহমানের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, গৃহিণী স্ত্রীর সম্পদ পুলিশ কর্মকর্তার চেয়ে অনেক বেশি। এটা প্রমাণিত যে, মোখলেসুর রহমান তার অবৈধ আয়কে বৈধ করতে যত ধরনের কৌশল আছে সেগুলো গ্রহণ করেছেন।

দুদক কর্মকর্তা আরও জানান, স্ত্রীর নামে যত সম্পদের বিবরণী পাওয়া গেছে সবই প্রকৃতপক্ষে মোখলেসুর রহমানের। কারণ, তিনি সব সম্পদের মালিক হয়েছেন বিয়ের পর। এছাড়া দুদকের অনুসন্ধানে আরও সম্পদের খোঁজ মিলেছে। যা তিনি অস্বীকার করেছেন। আমরা সব কিছু যাচাই-বাছাই করছি।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্ত্রী শরীফা বেগম মনি ২০১০ সালের ৩০ জুন কক্সবাজারে কলাতলীর সায়মন বিচ রিসোর্টে ৪৭৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন। রেজিস্ট্রেশন সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকার শান্তিনগরে শেলটেক রহমান ভিলায় কার পার্কিংসহ ২৩৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কেনেন তিনি। নিজ বাড়ি নেত্রকোনা সদরে ৩০ শতাংশ জমি কিনেছেন ২০১৩ ও ২০১৪ সালে। এছাড়া ২০১৪ সালে ২১ লাখ টাকার পুরাতন ১৫০০ সিসির টয়োটা গাড়ি (রেজি নং-৩১-৪৭৯৯) কেনেন মনি।

মনির অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে, ২০১৩,২০১৫,২০১৬,২০১৭ ও ২০১৮ সালে ১০ লাখ ও ১৫ লাখ করে মোট ৭০ লাখ টাকার পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্র। এছাড়া নিজের নামে রয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার ১৮০ টাকার জীবন বীমা।

এতো সম্পদের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে মোখলেসুর রহমান ও তার স্ত্রী দুদককে জানিয়েছেন, তারা নারীদের শাড়ি ও পোশাক বিক্রির ব্যবসা থেকে অতি মুনাফা, সঞ্চয়পত্রের সুদ, শেয়ার মার্কেটের তালিকাভুক্ত কোম্পানিরর শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়, মিশম্যাক ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সিনিয়র রিপ্রেজেনটেটিভ পদে চাকরির বেতন-ভাতা, বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার, লন্ডনে কর্মরত ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ এবং সৌদিতে কর্মরত ভাগ্নের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন।

আরএম/এসআরএস