র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার মাহমুদ হাসান গুনবি

জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবি ওরফে হাসান মাদরাসায় শিক্ষকতার আড়ালে জঙ্গি মতাদর্শ ছড়ানোর কাজ করতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট গ্রুপ গঠন করতেন তিনি। এরপর মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে গ্রুপের সদস্যদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতেন।

শুক্রবার (১৬ জুলাই) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান এলিট ফোর্সটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। 

এর আগে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর শাহ আলী থানার বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় উগ্রবাদী পুস্তক ও লিফলেট।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার গুনবি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনার পর মাদরাসায় ভর্তি হন। ২০০৮ সালে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন। এরপর ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি ধর্মীয় মতাদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন। ২০১০ সাল থেকে তিনি ওয়াজ মাহফিল শুরু করেন। ২০১৪ সাল থেকে ধর্মীয় বক্তব্যে উগ্রবাদ প্রচারে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। এছাড়া গুনবি ধর্মীয় পুস্তকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, গ্রেফতার গুনবি প্রথমে জঙ্গি সংগঠন হুজির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে আধ্যাত্মিক জঙ্গি নেতা জসিম উদ্দিন রহমানির সঙ্গে তার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়। এরপর থেকে আনসার আল বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। জসিম উদ্দিন রাহমানি গ্রেফতারের পর উগ্রবাদ প্রচারক হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন। জঙ্গি নেতা গুনবি আনসার আল ইসলামের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মাদরাসায় শিক্ষকতা ও মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে তিনি যুক্ত। এসব মাদরাসায় সম্পৃক্ত হয়ে তিনি জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে অনেক পরিচিতি ছিল গুনবির। সাধারণ জঙ্গিদের তিনি আত্মঘাতী হিসেবে উদ্বুদ্ধ করতে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনে ভূমিকা পালন রাখতেন। এছাড়া আনসার আল ইসলামের (এবিটি) অন্যতম একজন দর্শন পরিবর্তনকারী তিনি। দর্শন পরিবর্তনের কৌশল সম্পর্কে গ্রেফতার গুনবি জানিয়েছেন, গোপন আস্তানায় তিনি বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে সংগঠনের সদস্যদের আত্মঘাতী হতে উদ্বুদ্ধ করতেন। আত্মীয়-স্বজন, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, বাইরের জীবন, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান থেকে তিনি প্রশিক্ষণার্থীদের দূরে রাখতেন এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ভয়ভীতি তৈরি ও স্বাভাবিক জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জাগ্রত করতেন। এভাবে কোমলমতিদের নৃশংস জঙ্গি হিসেবে গড়ে তুলতেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গত ৫ মে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা জঙ্গি আল সাকিব গ্রেফতার হন। আধ্যাত্মিক নেতা গুনবির মাধ্যমে সাকিব আত্মঘাতী হয়েছিলেন। সাকিব ঢাকায় পুলিশের ওপর এবং সংসদ ভবন এলাকায় হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। গুনবির ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বেশ কজন জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে-সাইফুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, আনিছুর রহমান ও হাসান। 
 
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মে মাসের প্রথম দিকে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন গুনবি। কুমিল্লা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির দুর্গম এলাকায় এলাকায় আত্মগোপন করেন তিনি। জুনের শেষের দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে গুনবি পুনরায় স্থান পরিবর্তন করে বান্দরবানে চলে যান। সেখানে দুই-তিনদিন অবস্থান করেন। পরবর্তী সময়ে লক্ষ্মীপুরের চর গজারিয়া ও চর রমিজে ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করেন। আবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা টের পেয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করেন। এরপর উত্তরবঙ্গে আত্মগোপন এবং দেশত্যাগের পরিকল্পনা করেন।

গুনবির কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ও হামলার পরিকল্পনা ছিল কি না জানতে চাইলে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা দেখেছি, তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনের কাজ করেছেন। তিনি একটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছেন। ওই সংগঠনের বিভিন্ন মিটিং বা মাহফিলে যোগ দিলেও তার কোনো সাংগঠনিক পদ ছিল না। তবে দাওয়াতে ইসলামের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে তিনি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন।

গ্রেফতার জঙ্গি ওসামার সঙ্গে গুনবির সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ওসামার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সে বিষয়ে সে আমাদের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রাজবাড়ীতে ওসামার যে মাদরাসা রয়েছে, সেখানে মাহফিলে তিনি নিয়মিত বক্তব্য দিতেন এবং উগ্রবাদী আদর্শ প্রচার করতেন। সেই মাদরাসায় তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে এসেছে, ওসামা ও সাকিবের যে পরিকল্পনা ছিল, সেখানে তারও সংশ্লিষ্টতা ছিল। আর এ হামলার পরিকল্পনায় তার গাইডলাইন ছিল।

গ্রেফতার জঙ্গি ওসামা ও সাকিবের কী পরিকল্পনা ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের পরিকল্পনা ছিল সংসদ ভবনের আশেপাশে জমায়েত হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করবেন। এ পরিকল্পনার সময় গুনবি আত্মগোপনে চলে যান। তাকে আমরা তখন খুঁজেছিলাম জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন ওসামা ও সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তখনও গুনবির নাম উঠে আসে।

৬ জুন গুনবিকে নোয়াখালী থেকে র‍্যাব উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে- এমন অভিযোগে গত শুক্রবার (৯ জুলাই) তার পরিবার সংবাদ সম্মেলন করে। এ বিষয়ে র‍্যাবের বক্তব্য জানতে চাইলে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ৬ জুনের পর থেকে র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট তাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করে আসছিল। যেহেতু তিনি আত্মগোপনে ছিলেন, তাই তাকে পাওয়া যায় এমন সব সম্ভাব্য স্থানে র‍্যাব অভিযান পরিচালনা করেছে। আমরা গতকাল তাকে গ্রেফতার করেছি। উগ্রবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মাহফিলে বক্তব্য দিতেন। তবে তার সর্বশেষ পরিকল্পনা ছিল উত্তরবঙ্গ হয়ে দেশ ত্যাগের।

গুনবির মতো বাংলাদেশের অনেক বক্তা তালেবানপন্থি। তাদের বক্তব্যের কারণে দেশের অনেক যুবকের মধ্যে তালেবানদের বিষয়ে সফট কর্নার তৈরি হচ্ছে। এ কারণেই তালেবানপন্থি বক্তাদের বিরুদ্ধে র‍্যাব অভিযান পরিচালনা করছে কি না জানতে চাইলে র‌্যাব কমান্ডার বলেন, দেশে যাতে জঙ্গির উত্থান না হয়, সেজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের তৎপরতার কারণে দেশে এখন পর্যন্ত জঙ্গি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতির ওপর আমরা নজর রাখছি। অনলাইনে বিভিন্ন জঙ্গি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল নজর রাখছে। 

গুনবির কাছ থেকে পাওয়া উগ্রবাদী বই, লিফলেট ও ব্যাগ

বাংলাদেশ থেকে তালেবানদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে দেশীয় জঙ্গিদের আফগানিস্তানে যাওয়ার কোনো প্রবণতা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা গ্রেফতার হচ্ছেন। র‍্যাব এ পর্যন্ত আনসার আল ইসলামের ৩৭০ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এখনও পর্যন্ত আফগানিস্তানে যাওয়ার বা তালেবানদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তাদের মধ্যে উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এক শ্রেণির স্কলাররা চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের অনেক স্কলারকে আমরা গ্রেফতার করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

গুনবিকে কেন আধ্যাত্মিক নেতা বলা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা গুনবির রয়েছে। গ্রেফতার জঙ্গি সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গুনবি  তাদের কাছে আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচিত। বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের মতাদর্শ পরিবর্তন করার একটি ক্ষমতা তার মধ্যে আছে। আনসার আল ইসলামের জঙ্গিদের বিভিন্ন সময় গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা গুনবির ওয়াজ মাহফিলে তার উগ্রবাদী মতাদর্শের বক্তব্য শুনে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। এছাড়া গুনবি বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রুপকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রাজবাড়ী মাদরাসায় নিয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে জঙ্গি মতাদর্শে যুক্ত করতেন। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে গুনবির কী ধরনের তৎপরতা ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন, যার অধিকাংশই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায়। খাগড়াছড়িতে তার নিজেরও একটি মাদরাসা রয়েছে। ওই জায়গাগুলো নিরিবিলি হওয়ায় সেখানে, বিভিন্ন গ্রুপকে মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ দিতেন গুনবি।

র‌্যাব কমান্ডার বলেন, সংগঠনের (আনসার আল ইসলাম) ভেতরে উগ্রবাদী মতাদর্শদের প্রচারে গুনবি ‘ছায়া সংগঠন’ পরিচালনা করতেন। যাদের ‘মানহাজি’ সদস্য বলা হয়। এসব সদস্যরা সংগঠনের ভেতরে জঙ্গি সদস্য তৈরি করতেন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিতেন। গ্রেফতার গুনবি ‘দাওয়াত ইসলাম’-এর ব্যানারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্তির বিশেষ উদ্যোগও গ্রহণ করেন। গুনবি মাহফিলের আড়ালে জঙ্গি সদস্য সংগ্রহ করতেন। আনসার আল ইসলামের কত জন মানহাজি পাওয়া গেছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত তিনজন মানহাজি আমরা পেয়েছি।

রাজধানীর কোন এলাকায় জঙ্গিদের তৎপরতা বেশি জানতে চাইলে তিনি বলেন, র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করলে দেখা যায় জঙ্গিদের তৎপরতা রাজধানীর মিরপুর এলাকায় বেশি। আমরা অনেক জঙ্গি মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছি।

গুনবির মাধ্যমে কত জন আনসার আল ইসলামে এসেছেন জানতে চাইলে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, নির্দিষ্ট সদস্য সংখ্যা জানা যায়নি। তবে দেশের বিভিন্ন জেলায় উগ্রবাদী বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি অনেককে আনসার আল ইসলামে নিয়ে এসেছেন।

হেফাজত ইসলামের সঙ্গে গুনবির কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরাসরি এ সংগঠনের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন সমাবেশে তিনি অংশ নিয়েছেন। দাওয়াতে ইসলামের মাধ্যমে কতজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে গুনবি ইসলাম ধর্মে আনতে পেরেছেন জানতে চাইলে র‌্যাব কমান্ডার বলেন, কয়েকজনকে তিনি আনতে পেরেছেন। 

এমএসি/আরএইচ