ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিন কারাগার থেকেই জুম অ্যাপসের মাধ্যমে মিটিং করার ঘটনায় ৩৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘রফিকুল আমিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেলে বসে পাঁচ দিন জুম মিটিংয়ে প্রায় ৫ ঘণ্টা কথা বলেছেন।’

সম্প্রতি রিপোর্টটি কারা মহাপরিদর্শকের (আইজি-প্রিজন্স) কাছে জমা দিয়েছে কারা অধিদফতরের তদন্ত কমিটি। কপিটি ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে।

আরও পড়ুন: ডেসটিনি, রফিকুল আমিন এবং জুম মিটিং ইতিবৃত্ত

এতে বলা হয়েছে, ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমিন গত ১১ এপ্রিল থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত এ হাসপাতালের প্রিজন্স অ্যানেক্সের সেল থেকে ৫ বার জুমে কথা বলেছেন। এতে তিনি নতুন কোম্পানি ডিটু-কে প্রতিষ্ঠিত করা ও বিনিয়োগকারীদের তার জামিনে মুক্তি বা খালাসের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। জুমে কথা বলে তিনি কারাবিধি ৭০৪(১) ও ৭০৫(৩)(৭)(৮)(৯)(৪৩) ধারা লঙ্ঘন করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে কারাবিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। 

কারাবিধি ৭০৪ (১) অনুযায়ী, রফিকুল আমিন কারাবিধি জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ করেছেন। এই অপরাধে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ‘যে কোনো বড় ধরনের সাজা’ দিতে পারে। ৭০৫ এর উপধারাগুলো বলছে, রফিকুল আমিন অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে অযৌক্তিকভাবে কর্মকর্তাদের বিপদের কারণ হয়েছেন, কারা কর্মকর্তাদের অসম্মানিত করেছেন। বহিরাগত বন্দি বা নাগরিকের সঙ্গে লিখিত, মৌখিক এবং অন্য কোনো উপায়ে যোগাযোগ করার করায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

ধারাগুলো লঙ্ঘনে যেসব সম্ভাব্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- জেলার শহরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে শুনানি করে ৬ মাস থেকে ১ বছরের অতিরিক্ত সাজা, আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করা, আসামি সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত না হলেও তাকে দিয়ে ৭ দিন কঠোর পরিশ্রমের কাজ করানো, ডাণ্ডাবেড়ি পড়িয়ে রাখা, ৩ মাসের জন্য কারাগারে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে একঘরে করে রাখা, ৯৬ ঘণ্টার জন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা ইত্যাদি।

রিপোর্টে ১২ জন কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা হচ্ছেন- প্রধান কারারক্ষী মীর বদিউজ্জামান, ইউনুস আলী মোল্লা, আনোয়ার হোসেন, সহকারী প্রধান কারারক্ষী বিল্লাল হোসেন, এনামুল হক, সরোয়ার হোসেন, জসিম উদ্দিন, কারারক্ষী আ. খালেক, মেহেদী হাসান, রিফাত হোসেন, ফারুক হোসেন ও জয়নাল আবেদীন। পাশাপাশি তদন্ত কমিটি প্রধান কারারক্ষী আবু সাঈদ অবসর-উত্তর ছুটিতে গমন করায় তাকে কঠোরভাবে সতর্ক করার জন্য সুপারিশ করেছে।

এছাড়াও ৪ ডেপুটি জেলারকে সতর্ক করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন তারা হলেন- খন্দকার মো. আল মামুন, তানিয়া জামান, মো. ফেরদৌস মিয়া ও মো. মনিরুল হাসান। 

এর আগে জুম মিটিং নিয়ে তদন্ত কমিটি করে কারা অধিদফতর। কারা ঢাকা বিভাগের ডিআইজি-প্রিজন্স তৌহিদুল ইসলাম কমিটির প্রধান ছিলেন। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন মুন্সিগঞ্জের জেল সুপার নুরুন্নবী ভুঁইয়া এবং নারায়ণগঞ্জের জেলার শাহ রফিকুল ইসলাম।

এর আগে ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে, ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন কারাবন্দি হওয়া সত্ত্বেও ভিডিও অ্যাপ ‘জুম’ ব্যবহার করে সহযোগীদের সঙ্গে মিটিং করেছেন। এ মিটিংয়ের দুটি ভিডিও রেকর্ডিং ঢাকা পোস্টের হাতে রয়েছে।

প্রতিবেদনে উঠে আসে, রফিকুল আমিন কেবল কাগজে-কলমে কিংবা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে ‘অসুস্থ’। হাসপাতালে থেকে দিব্যি ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন। মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার করে জুম অ্যাপে নিয়মিত মিটিংও করছেন। ঢাকা পোস্টের হাতে তার এমন জুম মিটিংয়ের দুটি ভিডিও রেকডিং এসেছে। যার একটি এ বছরের মে মাসের এবং আরেকটি জুন মাসের।

ভিডিওতে দেখা যায়, রফিকুল আমিন ডেসটিনির মতোই নতুন আরেকটি এমএলএম ব্যবসার বিষয়ে আলোচনা করছেন। ইতোমধ্যে সেই ব্যবসা শুরুও করেছেন তিনি। ব্যবসার জন্য শিগগিরই এক হাজার ৩০০ মার্কেটিং এজেন্ট নিয়োগের কথা বলেন।

ঢাকা পোস্টের কাছে আসা জুম মিটিংয়ের রেকর্ড করা ভিডিওতে রফিকুল আমিনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি সেখানে ‘মিস্টার এ’ নামে রেজিস্ট্রি করেন। তার প্রোফাইল ছবিতে ইংরেজি বর্ণের বড় হাতের ‘R (আর)’ লেখা। ব্যবসার বিষয়ে আলাপকালে তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি- ২০০০ লিমিটেডের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে তাকে কথা বলতে শোনা যায়।

এছাড়া নতুন ব্যবসায় ধীরগতির বিষয়ে মিটিংয়ে রফিকুল আমিন বলেন, ‘কেরানীগঞ্জে (কারাগারে) যাওয়ার কারণে সেই কাজটা পিছিয়ে গেছে।’ এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জেলে থেকে কোরআন-হাদিসের অনেক জ্ঞান নিয়েছি।’

রফিকুল আমিন কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। তবে, ডায়াবেটিসের সমস্যার কথা বলে গত এপ্রিলে তিনি বিএসএমএমইউতে ভর্তি হন। হাসপাতালে চিকিৎসকের অধীনে থাকলেও তার নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় কারাগারের দুজন রক্ষী সবসময় দায়িত্ব পালন করেন।

২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমিন এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।  

ওই বছরের ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হন রফিকুল আমিন ও মোহাম্মদ হোসেন। ২০১৪ সালের ৪ মে দাখিল করা অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় মোট ৫৩ জনকে। তাদের বিরুদ্ধে চার হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং ৯৬ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগ আনা হয়। গ্রেফতারের পর থেকে কারাগারে ছিলেন রফিকুল আমিন। তবে, ডায়াবেটিসের সমস্যার কথা বলে গত এপ্রিলে তিনি বিএসএমএমইউতে ভর্তি হন।

এআর/এইচকে