আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে বেশ কিছুদিন আগে। এ নিয়ে তদন্ত করছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রাথমিক তদন্তে তারা এই প্রতিষ্ঠানটির টাকা পাচারের সত্যতা পেয়েছে।

সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তাদের কাছে তথ্য ছিল, ধামাকা ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিগগিরই ধামাকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে।

এদিকে ধামাকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জসীম উদ্দীন চিশতি ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিআইডি বার বার ডাকলেও তিনি আসেননি। ‘মহামারির কারণে তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না’ বলে সিআইডিকে জানিয়েছে ধামাকার সংশ্লিষ্টরা। তবে এমডি জসিম নিজে সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, ধামাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্য দেওয়ার নাম করে অগ্রিম নেওয়া প্রায় ৫০ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছে। এর সিংহভাগ টাকা তারা ‘ডাবল টাকা ভাউচার’ এবং ‘সিগনেচার কার্ড’ স্কিমের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে।

ধামাকার ঊর্ধ্বতনদের সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ
অর্থ পাচারের বিষয়ে জানতে ধামাকার এমডি জসীম উদ্দীন, সিইও সিরাজুল ইসলাম, অ্যাকাউন্টস ও ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান আমিনুর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কার্যালয়ে ডাক দেয় সিআইডি। দুই কর্মকর্তা সিআইডি কার্যালয়ে হাজিরা দিলেও উপস্থিত হননি এমডি।

এমডির বিষয়ে জানতে চাইলে ওই দুই কর্মকর্তা সিআইডিকে জানান, এমডি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। করোনা মহামারির কারণে তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না। তাই তিনি জিজ্ঞাসাবাদের চিঠি পেয়েও উপস্থিত হতে পারেননি।

ধামাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে মাত্র ৯৩ হাজার টাকা
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ধামাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্য বিক্রির নামে যে অগ্রিম টাকা আদায় করত সেটি রাখা হতো ‘ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকম’-এর নামে খোলা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। সেই অ্যাকাউন্টে গত ৮ মাসে ৫৮৮ কোটি টাকা লেনদেন করা হলেও বর্তমানে সেটির ব্যালেন্স মাত্র ৯৩ হাজার টাকা।

এদিকে সম্প্রতি ধামাকা ও প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতনদের ব্যক্তিগত মোট ১৪টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে সিআইডি। সেই অনুযায়ী অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়।

জব্দ করা অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে এমডি জসীম উদ্দীনের নামে ৫টি, ইনভ্যারিয়ান্ট টেলিকমের ৭টি, মাইক্রো ট্রেড নামে একটি এবং মাইক্রো ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে।

বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা, এনআইডি ব্লকড
সিআইডির পক্ষ থেকে ধামাকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইমিগ্রেশন বিভাগে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্লক করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়।

যাদের নাম উল্লেখ করে চিঠিগুলো দেওয়া হয়েছে তারা হলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জসীম উদ্দীন চিশতি, উপ-মহাব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নাজিম উদ্দীন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিরাজুল ইসলাম, পরিচালক (অপারেশন্স) সাফওয়ান আহমেদ, অ্যাকাউন্টস ও ফাইনান্স বিভাগের প্রধান আমিনুর হোসেন।

পাচারের ইনগ্রেডিয়েন্টস পাচ্ছি, মামলা হবে : সিআইডির কর্মকর্তা
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা অনুসন্ধান করছি। আমরা তাদের আর্থিক লেনদেনে মানি লন্ডারিংয়ের (অর্থ পাচারের) ইনগ্রেডিয়েণ্টস (উপাদান) পাচ্ছি। তাদের ঊর্ধ্বতনদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। অনুসন্ধান শেষ হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করব।

পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়েই ধামাকার অবাস্তব ডিসকাউন্ট 
২০২০ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে ধামাকা। শুরু থেকেই প্রতিটি পণ্যে ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ ডিসকাউন্টে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা আদায় করে তারা। এরপর প্রতিশ্রুত সময়ের পরেও দীর্ঘদিন পণ্য না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া না দেওয়া পণ্যের রিফান্ডের টাকাও ফেরত দেয়নি তারা। এসব অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি।

অনুসন্ধানে সিআইডি জানতে পারে, বাংলাদেশের একমাত্র ই-কমার্স সাইট হিসেবে বিলাসবহুল গাড়িতেও ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিয়েছে ধামাকা। বেশ কয়েকটি গাড়ির আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলে সিআইডি জানতে পেরেছে, ধামাকা যেসব গাড়িতে ছাড় দিয়ে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছে, সেগুলো এ দামে বিক্রি প্রায় অসম্ভব।

এছাড়া ধামাকা তাদের ওয়েবসাইটে ডিসকাউন্টে র‍্যাংগস মটরস এর মার্সিডিস বেঞ্জ গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছে। অথচ র‍্যাংগসের সঙ্গে ধামাকার গাড়ি বিক্রি বা সরবরাহের বিষয়ে কোনো চুক্তিই হয়নি। তাদের এমন চটকদার বিজ্ঞাপনের একমাত্র কারণ ছিল গ্রাহক থেকে নগদ টাকা সংগ্রহ।

এছাড়া ধামাকা ৪৮ শতাংশ ডিসকাউন্টে সিঙ্গার ব্র্যান্ডের ফ্রিজ বিক্রির কথা বলে গ্রাহক থেকে টাকা নিয়েছে। তবে সিঙ্গার জানায়, ফ্রিজটি তৈরিতে সিঙ্গারের যত টাকা খরচ হয়েছে ধামাকা এর চেয়েও কম দামে ফ্রিজটি গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অফার করেছে। কীভাবে তারা এমন করল তা র‌্যাংগসের জানা নেই।

বিকাশ ও ১০ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ধামাকা
সন্দেহজনক লেনদেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অমান্য এবং গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে ধামাকা থেকে গ্রাহকদের কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ১০ ব্যাংক ও পেমেন্ট গেটওয়ে বিকাশ। ব্যাংকগুলো হচ্ছে ডাচ-বাংলা ব্যাং‌ক, প্রাইম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এম‌টি‌বি), ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং সিটি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা তা‌দের ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ড দিয়ে এই ই-কমার্স সাইটে পণ্য অর্ডার দিতে পারবেন না।

এছাড়া বিকাশ ওয়ালেট থেকেও ধামাকায় পণ্য ক্রয় বন্ধ করা হয়েছে। বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-কমার্সের ক্ষেত্রে রেগুলেটর প্রদত্ত পেমেন্ট বিষয়ক নীতিমালাগুলো কার্যকর করতে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এই সময়ে গ্রাহকদের স্বার্থেই ধামাকাসহ কিছু মার্চেন্টের জন্য বিকাশের পেমেন্ট গেটওয়ে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।

এআর/এসএম/জেএস