ডা. সাবিরা

রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক সাবিরা রহমান লিপি হত্যাকাণ্ডের দুই মাস অতিবাহিত হলেও খুনি ও খুনের নেপথ্যে কারা, সে সম্পর্কে কোনো ক্লু পাচ্ছে না পুলিশ। কোনোভাবেই খুলছে না রহস্যের জট। আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্ত এখন অনেকটাই গোলকধাঁধায়।

ডা. সাবিরা হত্যার ঘটনায় অন্তত দুই ডজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এর মধ্যে আছে পরিচিত বন্ধু, আত্মীয় স্বজন ও বাসাটির অন্য বাসিন্দারা। তবে কারো কাছ থেকেই মেলেনি আমলযোগ্য কোনো তথ্য। মামলার বাদী রেজাউল হাসান সাবলেটে থাকা তরুণীকে সন্দেহ করলেও তাকেসহ হেফাজতে নেওয়া সবাইকেই ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেছে, ডা. সাবিরা হত্যাকাণ্ডের শিকার। আগে হত্যা, পরে আগুন দিয়ে হত্যার আলামত নষ্টের অপচেষ্টাও হয়েছে। এসবই এখন স্পষ্ট। কিন্তু কে খুনি, কেনই বা খুন হতে হলো ডা. সাবিরাকে? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। এমনও হতে পারে, জিজ্ঞাসাবাদে খুনিও হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু খুনি কে বা কারা তা শনাক্ত করার মতো কোনো তথ্য বা ক্লু মিলছে না। অন্যদিকে ফরেনসিক পরীক্ষায়ও বিশেষ কোনো তথ্য মেলেনি। তবে এখনো ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পায়নি পুলিশ। 

এদিকে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন বাদী রেজাউল হাসান ।

মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় মামলার তদন্ত তত্ত্বাবধায়ক ও রমনা বিভাগের কলাবাগান জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের আগে মামলাটির তদন্তভার পিবিআইয়ের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। যদিও এখনো অফিসিয়ালি যায়নি। পিবিআই দায়িত্ব পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। তদন্ত এগিয়েছে কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। রহস্য এখনও উদঘাটন হয়নি। আসলে বলার মতো অগ্রগতি হয়নি। আমরা সবাই চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, আমরা দুই মাসেও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাইনি। এটি খুব দরকার। হয়ত বিধিনিষেধের কারণে সমস্যা হচ্ছে। আমরা নিহতের মোবাইল ফরেনসিক করেছি। বিশেষ কিছু পাইনি। আমরা তার হোয়াটসঅ্যাপও দেখেছি, সেরকম কনভারসেশন বা তথ্য মেলেনি। আমরা খুনের আগে ও পরে সন্দেহভাজনদের ফোনকল যাচাই করেছি, তার সিমের কল ডাটা খতিয়ে দেখেও কিছু পাইনি।

শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান বলেন, ডা. সাবিরা খুন হয়েছেন, এটা নিশ্চিত। কিন্তু কে বা কারা খুন করল, কেন করল তা শনাক্ত করা যায়নি। কল্পনা-নির্ভর কিছুই এখানে কাজ করছে না।

তিনি বলেন, আমরা অন্তত দুই ডজন মানুষকে হত্যার ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। বাদীর সন্দেহভাজন সাবলেট বাসিন্দা কানিজ সুবর্ণাসহ হেফাজতে থাকা সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। 

পূর্বপরিকল্পনায় খুন, খুনি খুবই চতুর-পেশাদার

ডা. সাবিরা হত্যার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। কিন্তু পুলিশ খুনের ঘটনাকে বলছে পূর্বপরিকল্পিত এবং খুনি ঠান্ডা মাথার।

এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান বলেন, খুনের ঘটনা পরিকল্পিত। খুনি ঠান্ডা মাথার। খুবই পরিকল্পিতভাবে খুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে এবং সুচারুরূপে গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট করা হয়েছে। 
আমাদের সন্দেহ, জিজ্ঞাসাবাদ করা দুই ডজন মানুষের মধ্যেই হয়ত খুনিও আমাদের মুখোমুখি হয়েছে। হয়ত সে চতুরতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদে কথাবার্তা বলেছে। সেরকম কোনো শক্ত তথ্যপ্রমাণ না থাকায় শনাক্ত বা ধরা যাচ্ছে না।

এর আগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, যে ভবনে হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেটির আশপাশে সিসিটিভি না থাকায় সংগ্রহ করা হয় দূরবর্তী একটি সিসিটিভির ফুটেজ। তবে তাতে কাঙ্ক্ষিত কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি।

হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একাধিক টিম। পরকীয়া, ডাকাত চক্র, পারিবারিক দ্বন্দ্বকে গুরুত্ব দিয়ে ক্লু খোঁজার চেষ্টা করছে তারা। তবে জানা গেছে, এখন অবধি তাদের তদন্ত ফলও শূন্য।

এ ব্যাপারে পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান শেলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক সংস্থাই কাজ করছে। আমরাও শুরু থেকে ছায়া তদন্ত করে আসছি। আমরা মূলত দুটি ডাইমেনশন বিবেচনায় তদন্ত করছি। ভিন্ন কিছু খুঁজছি। খুন করার পর আলামত নষ্ট করা হয়েছে নাকি খুনের আগে আগুন দেওয়া হয়েছে, পূর্বপরিকল্পিত নাকি তৎক্ষণাৎ খুন তা আগে তদন্ত করে দেখছি। আমরা দুই ধরনেরই তথ্য পাচ্ছি। এ পর্যন্ত খুনি কে সেটা স্পষ্ট নয়। আমরা কাজ করছি। আমাদের অনেকগুলো টিম সেখানে নিবিড়ভাবে কাজ করছে। আশা করছি খুনের মোটিভ বের করা সম্ভব হবে। 

গত ৩১ মে কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের ভাড়া বাসায় খুন হন ডাক্তার সাবিরা। প্রথমে আগুনের খবরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে যায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। নিহত চিকিৎসকের শরীরের কিছু অংশ দগ্ধ ছিল বলে জানান ফায়ারকর্মীরা। মরদেহ উদ্ধারের পর পিঠে দুটি ও গলায় একটি ধারাল অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পায় পুলিশ।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। আলামত সংগ্রহের পর ক্রাইম সিন ইউনিট জানায়, সাবিরাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা (ব্রুটালি কিলড) করা হয়েছে। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দাহ্য পদার্থ না থাকায় আগুন তেমন ছড়ায়নি। তবে সাবিরার শরীরের কিছু অংশ এতে দগ্ধ হয়।

ঘটনার দিন সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের পরিদর্শক শেখ রাসেল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাবিরার শ্বাসনালী কেটে ফেলা হয়েছে। তার দেহে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও পোড়ার ক্ষত আছে। আমরা আপাতত নিশ্চিত হয়েছি, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। আলামত দেখে মনে হয়েছে, মধ্যরাতের যেকোনো সময় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে। 

জেইউ/এসএসএইচ/জেএস/এইচকে