সাকরাইনে আকাশে ঘুড়ির মেলা

পৌষ মাসের শেষ দিন ও মাঘের প্রথম প্রহরে আগুন নিয়ে খেলা, আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাকরাইন। পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসবের অংশ হয়ে আছে ঘুড়ি ওড়ানো। পুরান ঢাকার মানুষ যাকে ‘সাকরাইন’ বলে তা মূলত ‘পৌষসংক্রান্তি’। একে শুধু ‘সংক্রান্তি’ও বলা হয়। 

সাকরাইন উৎসবকে ঘুড়ি উৎসবও বলা হয়। সাকরাইন উৎসব আদি ঢাকার প্রাচীন ঐতিহ্য। এই উৎসব উপলক্ষে ঘরে ঘরে নানান ধরনের পিঠা করা হয়। 

জানা যায়, পুরান ঢাকার জামাইরা পৌষ মাসের শেষে শ্বশুরবাড়ি আসতেন। তখন তারা ঘুড়ি ও নাটাই নিয়ে উৎসবে মাততেন। সব বাড়ির জামাই ঘুড়ি ওড়ালে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে তা দেখতেন এলাকাবাসী। এমনটা এখন আর হয় না। শহরে এখন শীতের তীব্রতা কমে গেছে। ঘুড়ি উৎসব এখন পৌষকে বিদায় দিয়ে মাঘকে বরণ করার উৎসবের অংশ হয়ে গেছে। 

সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রাণ’ থেকে এসেছে ‘সাকরাইন’। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘বিশেষ মুহূর্ত’। দেশের বাইরে অনেক দেশেই এই উৎসব পালন করা হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে। সাকরাইনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দুটি ভিন্ন ব্যঞ্জনা রয়েছে। পৌষ মাসের শেষ দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ব্রাহ্মণ ও প্রজাদের আতিথেয়তা দেন। এটা সংক্রান্তির ধর্মীয় দিক।

সাকরাইনে পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উৎসবের সঙ্গে কালের বিবর্তনে যোগ হয়েছে আতশবাজি, নাচ-গান ইত্যাদি। পুরো সপ্তাহ জুড়ে পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে আনন্দমুখর পরিবেশে চলে সাকরাইনের প্রস্তুতি, চলে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার ধুম। এদিন বাহারি রঙের ঘুড়িতে আকাশ হয়ে ওঠে ঘুড়িময়। ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণে প্রতিটি বাড়ির ছাদ হয়ে ওঠে উৎসব মুখর। আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে উৎসবের জৌলুস। এদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে গান-বাজনা, ফানুস আর আতশবাজির খেলা। 

ঢাকার অন্য এলাকায় এ উৎসবের তেমন সাড়া না পাওয়া গেলেও পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, শাঁখারী বাজার, মিলব্যারাক, লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, নবাবপুর, বংশাল, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, ধুপখোলা, ওয়ারী এলাকার মানুষ সাকরাইন উৎসব জাঁকজমকভাবে পালন করে। আশপাশের এলাকার চেহারা থাকে অন্যরকম। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমার, কম্বোডিয়াম ও ভারতে পৌষসংক্রান্তির উৎসব পালন করা হয়।

সাকরাইনের আয়োজন শুরু হয় পৌষের শুরু থেকেই। রঙিন কাগজ কেটে ঝালর বানিয়ে কিংবা পাখি, ফুল আর নানা ধরনের আকৃতি বানিয়ে বাড়ির ছাদে, জানালায়, বারান্দায় ঝুলিয়ে দেয় স্থানীয়রা। মুখরোচক খাবারের আয়োজন থাকে অতিথিদের জন্য। 

সাকরাইনে পটকা আর আতশবাজির খেলা চলে। মুখে কেরোসিন নিয়ে হাতে ধরা কাঠি আর মশালের উপর ফু দিলেই আগুনের হল্কা বেড়িয়ে আসে- এই খেলাটিও জনপ্রিয়। 

সাকরাইনে যত প্রোগ্রাম
সকাল থেকে শুরু হয়ে ঘুড়ি উৎসব। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যার শুরু থেকেই আতশবাজি শুরু হয়। এর সাথেই চারদিক আলোকিত হয় ‘ফায়ার ব্রিদিং’র দাপটে। আরেক আকর্ষণ ‘লাইট শো’। ডিসকো জকি (ডিজে) মিউজিকের তালে ফানুস উড়ানোর মোহে মেতে থাকে সকলে। খাবার হিসেবে থাকে বিরিয়ানি, কাবাব, পরোটা, দই ফুচকা, হাওয়াই মিঠাই, আগুন পান, পিঠা, চা, কফি ইত্যাদি।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতু সাকরাইন
সাকরাইন উৎসব বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা আজিম বখশ বলেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতো। তা দূর করে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তুলেছে সাকরাইন উৎসব।’ 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সাকরাইনের রাতে পুরান ঢাকার আকাশ আলোয় ভরে ওঠে।  চাঁদা তুলে ঘুড়ি ওড়ানোসহ বিভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়। এলাকা কাঁপিয়ে নাচ-গান চলে। ফানুস ওঠানো ছাড়াও সকলে আগুন-খেলায় মেতে ওঠে।

সাকরাইনের ঐতিহ্য নিয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দা একরামুল হক বলেন, সাকরাইন উৎসব এলে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। সাকরাইন উৎসব বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয়।

তিনি বলেন, সাকরাইন উৎসবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে। কালের পরিবর্তনে উৎসবে পরিবর্তন এলেও আবেগটা কিন্তু এখনও ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে।

এবার ‘এসো ওড়াই ঘুড়ি, ঐতিহ্য লালন করি’ স্লোগান সামনে রেখে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে আয়োজন করা হবে সাকরাইন। ১৪ জানুয়ারি এবার ঢাকা মাতবে সাকরাইন উৎসবে। 

এইচকে