পরীমণি (বাঁয়ে) ও গোলাম সাকলায়েন শিথিল (ডানে)

পরীমণিকে নিয়ে বাসায় ১৮ ঘণ্টা কাটানোর অভিযোগ ওঠায় এরইমধ্যে এডিসি গোলাম সাকলায়েন শিথিলকে গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সব কার্যক্রম থেকে নিবৃত করা হয়েছে। এবার সেই ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দফতর।

রোববার (৮ আগস্ট) পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি মিয়া মাসুদ করিমকে (ট্রেনিং) প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি মিডিয়া হায়দার আলী খান।

বাকি দুজনের একজন হলেন, ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারের উপ-কমিশনার (ডিসি) হামিদা পারভিন এবং অন্যজন সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) রুমানা আক্তার।

সাকলায়েন যে মামলার তদারকি কর্মকর্তা সেই মামলার তথ্য, তার বাসায় পরীমণির আসা-যাওয়ায় মামলার তদন্তে কোনো প্রভাব পড়েছে কি না, সাকলায়েন পুলিশের আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধ করেছেন কি না, তদন্ত প্রতিবেদনে ইত্যাদি তুলে ধরতে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কমিটিকে ১৫ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, এ ঘটনা তদন্তে ডিএমপি সদর দফতর থেকেও আলাদা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মুখপাত্র ও অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযোগ করার পরই সাকলাইনকে ডিবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় ডিএমপি সদর দফতর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তদন্ত কমিটি হয়নি। যদি হতো, তবে আমি জানতাম। হয়তো আগামীকাল সকালের মধ্যে জানা যাবে।

শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ডিএমপির মিডিয়া উইং থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এডিসি গোলাম সাকলায়েনকে ডিবির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) পশ্চিমে পদায়িত করা হয়েছে।

সাভারের বোট ক্লাবে পরীমণিকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তের তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে কর্মরত সাকলায়েন। তদন্ত চলাকালে তার বাসায় একাধিকবার যাতায়াত করেছেন পরীমণি। এ সময় পরীর সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তার। এ পুলিশ কর্মকর্তা ও পরীমণি বিভিন্ন সময় গাড়িতে একসঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরাও করেছেন। 
সম্প্রতি সাকলায়েনের বাসায় যাতায়াতের সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশিত হয়েছে। এমন একটি ফুটেজ ঢাকা পোস্টের হাতেও এসেছে।

সিসিটিভি ফুটেজ দেখা যায়, ১ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে পরীমণির সাদা রংয়ের হ্যারিয়ার গাড়িটি নিয়ে গোলাম সাকলায়েনের রাজারবাগের অফিসার্স কলোনির মধুমতি ভবনের ৯/সি নম্বর সরকারি ফ্ল্যাটের বাসায় আসে। প্রথমে সেই গাড়ি থেকে লাল রংয়ের টি-শার্ট পরে বের হন সাকলায়েন। সাদা রংয়ের একটি স্লিপিং গাউন পরে নামেন পরীমণি। রাত সোয়া দুইটায় ওই ভবন থেকে বের হন তিনি। তবে রাতে বের হওয়ার সময় পরীমণির পরনে ছিল কালো রংয়ের পোশাক, আর সাকলায়েনের গায়ে সাদা টি-শার্ট।

সম্প্রতি ডিবিতে জিজ্ঞাসাবাদেও পরীমণি সাকলায়েনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে পরীমণির সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপুও এ সম্পর্কে বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। 

ডিবির একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, সাকলায়েন নিজেকে অবিবাহিত দাবি করে মামলার তদন্তের সময় পরীমণির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু সাকলায়েন বিবাহিত, বিষয়টি জানার পর পরীমণি ও তার মধ্যে মনমালিন্য সৃষ্টি হয়। পরে দীপুর উদ্যোগে পরীমণির সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। ঈদুল আজহার সময় পরীমণির বাসায় তিন দিন ছিলেন সাকলায়েন। তখন বাসায় তারা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।

এ বিষয়ে পরীমণির গাড়িচালক নাজির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজারবাগ পুলিশ কোয়ার্টারে পরীমণিকে গত ১ আগস্ট সকালে তিনি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার রাতে পরীমণির ফোন পেয়ে তাকে আনতে যান। তারা দুজনই গাড়ি চালাতে পারেন। তারা মাঝেমধ্যেই আমাকে রেখে নিজেরা ড্রাইভ করে হাতিরঝিলে ঘুরতে যেতেন। গাড়ি চালানো অবস্থায় তারা কোনো কথা বলতেন না। তবে গাড়িতে মদ্যপান করতেন। আবার মাঝেমধ্যে তারা একা গাড়ি নিয়ে বের হতেন।

এ বিষয়ে জানতে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত ডিবির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তারকে সাত বার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। সাকলায়েনের ব্যক্তিগত নম্বরে দুবার ফোন দেওয়া হলে সেটি আনরিচেবল পাওয়া যায়।

শুক্রবার সন্ধ্যায় পরিচালক চয়নিকা চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে মিন্টু রোডে গোয়েন্দা কার্যালয়ের বাইরে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ। এ সময় মামলার বাদীর সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তার ১৮ ঘণ্টা বাসায় সময় কাটানোর বিষয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। প্রশ্ন শুনে হারুন অর রশীদ উত্তর না দিয়েই গেটের ভেতরে চলে যান।

এদিকে, শনিবার সকালে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে কথা বলেন সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক। এ সময় এক সাংবাদিক জানতে চান, বোট ক্লাবে শ্লীলতাহানি চেষ্টা মামলার বাদী পরীমণির সঙ্গে ১৮ ঘণ্টা সময় কাটানোর বিষয়টি তদন্তে উঠে আসবে কি না।

উত্তরে শেখ ওমর ফারুক বলেন, আমরা থরোলি তদন্ত করব। বিষয়টি আমাদের তদন্তে থাকবে। আমরা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে যা পাব, মিডিয়াতে যা এসেছে, সব নিয়েই তদন্ত করব। তদন্ত কর্মকর্তা কিংবা যেই হোক না কেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যা সত্যি, তা উদঘাটন করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযোগের সম্পর্কে আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। আমার মনে হয়, নিশ্চিত হওয়ার আগে কোনো ধরনের মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

গোলাম সাকলায়েন ৩০তম বিসিএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলায় তার স্ত্রী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে।

জেইউ/আরএইচ