সন্দ্বীপে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষের বসবাস

সাগর বেষ্টিত দ্বীপ। সেখানে এক নারী করোনা আক্রান্ত। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমছে, বাড়ছে শ্বাসকষ্ট। শিগগিরই আইসিইউ দরকার। কিন্তু এই দ্বীপে নেই ভালো মানের কোনো সরকারি হাসপাতাল, আইসিইউ তো স্বপ্ন। ডাক্তার বললেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত দ্বীপের বাইরে নিতে। 

রোগী নিয়ে সাগর পাড়ি দেওয়া সহজ নয়। দ্বীপে দুটি সরকারি ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ আছে বটে। কিন্তু তার জন্য তেলের বরাদ্দ নেই। নেই কোনো চালক। 

নারীর অবস্থা গুরুতর হচ্ছে। সাগরের ঢেউ ভেঙে ঝুঁকি নিয়ে যেতে চাইছে না স্পিডবোট ও ট্রলার। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর একজন দয়া করেন। সাত হাজার টাকায় রিজার্ভ করা স্পিডবোট রওনা হলো চট্টগ্রামের উদ্দেশে। ঢেউ ভেঙে অথৈ সাগরে ছুটে চলা। স্পিডবোটে বসে থাকার মতো শারীরিক অবস্থা কি করোনা রোগীর থাকে? স্বজনরা প্রাণপণে দোয়া করছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। 

বিস্তৃত আকাশের নিচে, নীল জলের বুকে ভাসতে থাকা স্পিডবোটে মারা গেলেন আয়েশা বেগম নামের ওই নারী। বাড়ি তার সন্দ্বীপ, চট্টগ্রামের সাগর বেষ্টিত দ্বীপ উপজেলা। 

সন্দ্বীপে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষের বসবাস। অথচ দ্বীপটিতে নেই ভালো মানের কোনো সরকারি হাসপাতাল। নেই আইসিইউ শয্যা। চট্টগ্রাম নগরীতে রোগী আনার জন্য নেই কোনো সরকারি ব্যবস্থাও। সরকারের পক্ষ থেকে সাগরপথে রোগী বহনের জন্য দুটি ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ দেওয়া হলেও কোনোটিরই সুফল পায়নি সন্দ্বীপবাসী। 

দ্বীপটিতে নেই ভালো মানের কোনো সরকারি হাসপাতাল

আয়েশা বেগমের আত্মীয় তারেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার কাকীমা (আয়েশা) করোনা আক্রান্ত ছিলেন। ৩ আগস্ট হঠাৎ তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। চিকিৎসকরা চট্টগ্রাম নগরীতে নিতে বলেন। সাত হাজার টাকায় স্পিডবোট রিজার্ভ করে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা করি। কিন্তু মাঝপথে মারা যান কাকী। আমরা ভাসতে থাকি- অসহায়। আমার মনে হয়, আমাদের মতো একই রকম অসহায়তার অনুভূতি পুরো সন্দ্বীপবাসীরই। 

তিনি বলেন, সরকারি একটি ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ চালু থাকলে হয়তো কাকীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে পারতাম। স্পিডবোটে তো রোগীকে বসিয়ে নিতে হয়। রোগীর জন্য সেটা কষ্টকর।  

তিনি আরও বলেন, দিনে তবু স্পিডবোট পাওয়া যায়। রাতে পাওয়া যায় না কিছুই। সরকার একটি ভালো মানের ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ দিলে মানুষের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমবে। 

‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ নিজেই অসুস্থ

হাওরে চলাচলের মতো ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ দেওয়া হয়েছে সাগরে চলাচলের জন্য- এমন অভিযোগ সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি চালক, বাজেট রাখা হয়নি তেলেরও। এই করোনাকালেও সন্দ্বীপের জরুরি রোগীদের ভরসা করতে হয়ে বেসরকারি স্পিডবোট ও ট্রলারের ওপর। 

জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে দেওয়া ‘সি অ্যাম্বুলেন্সটি’ কেনা হয়েছিল ২০০৮ সালে। এটার দাম ৩৫ লাখ টাকা। বহুদিন অচল থাকার পরে ২০১১ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে অস্থায়ীভাবে একজন চালক ও জ্বালানি তেলের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় এক বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায় অ্যাম্বুলেন্সটির সেবা। এরপর আর চালু হয়নি। পড়ে আছে অকেজো অবস্থায়। অপরদিকে, ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উপজেলা প্রশাসনকে ৬৫ লাখ টাকার একটি ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ দেওয়া হয়। আগেরটির মতো এটিরও চালক ও জ্বালানি বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

দুটি সি অ্যাম্বুলেন্সের একটিরও নেই উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো ফিটনেস। স্থানীয় সংসদ ও সন্দ্বীপবাসীর অভিযোগ, এই অ্যাম্বুলেন্স দুটি ক্রয় করে সরকারের টাকা অপচয় হয়েছে। উপকার হয়নি জনগণের। 

আছে ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’, তবে তেল ও চালক নেই

স্থানীয়রা জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় স্পিডবোটে বা ট্রলারে। রোগী পরিবহনের সময় সেগুলোও সময় মতো পাওয়া যায় না। বিশেষ করে রাতে কোনো গুরুতর রোগীকে চট্টগ্রাম নগরীতে নিতে হলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়। করোনাকালে সেই দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। 

অপু ইব্রাহিম নামের স্থানীয় এক সংবাদকর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অ্যাম্বুলেন্সটি সন্দ্বীপ চ্যানেলে চলাচলের উপযোগী নয়। সন্দ্বীপ চ্যানেলে চলাচলের উপযোগী একটি ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামে চালানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সাগরের ঢেউয়ে এগুলো উল্টে যায়।

তিনি বলেন, একটি ‘সি অ্যাম্বুলেন্সে’ আমি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন একবার উঠেছিলাম। সাগরের স্বাভাবিক অবস্থাতেই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম। 

সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াত করে স্পিডবোট

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামে একটি বড় জাহাজ চলাচল করে। রোগী ও সাধারণ মানুষ এটা দিয়েই যাতায়াত করে। এছাড়া স্পিডবোট ও ট্রলারেও যাতায়াত করে। 

তিনি বলেন, সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা সি অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছি। এখনও পাইনি। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। 

সন্দ্বীপের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ফজলুল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ প্রায় নষ্টের পথে। এটা ২০০৮ সালের দিকে এসেছিল স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে। এটা এখন ঠিক করার পর্যায়েও নেই। আরেকটা ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছর আগে। এটাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এদিকে, অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছে কিন্তু কোনো চালক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। হেলপার নেই। জ্বালানিরও ব্যবস্থা করা হয়নি। 

এগুলো দিয়ে কি কখনো রোগী পরিবহন করতে পেরেছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ‘সি অ্যাম্বুলেন্স’ দিয়ে মাঝে একবছর অনিয়মিতভাবে হাতেগোনা কয়েকজন রোগী ঝুঁকি নিয়ে পরিবহন করা হয়েছে। 

উপজেলা প্রশাসনের কাছে ৬৫ লাখ টাকার যে অ্যাম্বুলেন্সটি দেওয়া হয়েছিল তা দিয়ে কোনো রোগী পরিবহন হয়নি। এটারও নেই কোনো চালক। নেই জ্বালানির বরাদ্দ। উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো ফিটনেসও নেই। উপজেলা পরিষদ দু-একবার দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। 

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সন্দ্বীপে আমি নতুন এসেছি। এগুলোর ব্যাপারে আসলেই জানতাম না। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখব। 

কেএম/এইচকে/এনএফ