একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন মো. শুভ। করোনার ধাক্কায় গত বছরের জুনে চাকরি হারান তিনি। চার মাস বেকার থাকার পর একই বছরের অক্টোবরে তিনি এক বন্ধুর পরামর্শে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ই-অরেঞ্জে বিনিয়োগ করা শুরু করেন। 

শুরুতে ই-অরেঞ্জের বিভিন্ন ভাউচার অফারের মাধ্যমে কয়েকটি স্মার্টফোন অর্ডার করেন শুভ। অর্ডার করার এক সপ্তাহের মধ্যে ফোনগুলোর ডেলিভারিও পেয়ে যান তিনি। ওই ফোনগুলো বিক্রি করে তার বেশ লাভ হয়। 

এরপর কয়েক দফায় ই-অরেঞ্জের আরও ভাউচার কেনেন শুভ। সময়মতো ডেলিভারি পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তার বিশ্বাস বেড়ে যায়। 

এ বছরের জুনে ই-অরেঞ্জের ‘সামার ডাবল অফারে’র মাধ্যমে ১৬ লাখ টাকার ভাউচার কেনেন শুভ। এই ১৬ লাখ টাকার ভাউচারে বেশকিছু মোটরসাইকেল কেনার ইচ্ছা ছিল তার।

তবে এবার ভাউচার কেনার পর ঘটে বিপত্তি। ই-অরেঞ্জ তাদের কার্যালয় ও সব কার্যক্রম বন্ধ করে গ্রাহকদের না দিচ্ছে পণ্য, না দিতে পারছে রিফান্ড। এতে অনেকটা পথে বসেছেন শুভ। শুধু শুভই নন, তার মতো হাজারো গ্রাহকের একই অবস্থা। 

এ পরিস্থিতিতে ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা এবার পথে নেমেছেন। সোমবার বিকেল থেকে রাজধানীর গুলশান-১ নম্বর এলাকার সড়ক এবং ই-অরেঞ্জের কার্যালয় অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেন গ্রাহকরা।

কর্মসূচিতে অংশ নেন  মিরপুরের বাসিন্দা শুভও। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে কয়েক দফা ডেলিভারি পেয়ে ই-অরেঞ্জের প্রতি বিশ্বাস বেড়ে যায়। মাশরাফি বিন মর্তুজা কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ায় বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। নিজের ৮ লাখ টাকা এবং বন্ধুদের কাছ থেকে আরও ৮ লাখ টাকা ধার করে মোট ১৬ লাখ টাকায় সামার অফারের ভাউচার কিনি। ভাউচার অনুযায়ী ই-অরেঞ্জের মোটরসাইকেল ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। আর মোটরসাইকেল না দিতে পারলে লভ্যাংশসহ মূল টাকা রিফান্ড করার কথা ছিল। কিন্তু ভাউচারের টাকা পরিশোধ করার পর থেকে তাদের কথা-কাজে মিল পাচ্ছিলাম না। আজ, কাল পরশু বলে আমাকে ঘোরাচ্ছে।’

শুভ বলেন, সর্বশেষ ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষ জানায়, লকডাউন শেষে ১১ আগস্ট তাদের অফিস খুলবে। পরে আবার বলে ১৬ আগস্ট খুলবে। আজ না খুলে বলছে ১৯ তারিখে খুলবে। এখন শুনছি কোম্পানি নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানের মালিক নাকি বিদেশে চলে যাবেন। তাই আমরা সড়কে নেমেছি। 

তিনি বলেন, ভাউচার কেনার এক মাসের মধ্যে পণ্য অথবা মূল টাকাসহ লভ্যাংশ পাওয়ার কথা ছিল। সে আশায় বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করেছিলাম এবং তাদের বলেছিলাম লভ্যাংশ দেব। কিন্তু আমার ১৬ লাখ টাকাই যেতে বসেছে। করোনায় চাকরি হারিয়ে ভেবেছিলাম, এখান থেকে পণ্য কিনে ব্যবসা করে চলব, তা না হয়ে তো উল্টো পথে বসে যেতে হচ্ছে। তারা যদি আমার টাকা না দেয়, তাহলে আমি শেষ হয়ে যাব। সরকারের কাছে আবেদন জানাই, ই-অরেঞ্জের প্রতারণা থেকে আমাদের রক্ষা করা হোক।

শুভর মতো পরিস্থিতিতে রয়েছেন মো. রায়হান নামে আরেক গ্রাহক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। বাড়তি কিছু টাকা আয়ের আশায় ই-অরেঞ্জের ৩ লাখ টাকার ভাউচার কিনি। কিন্তু গত তিন মাস ধরে শুধু ঘুরছি আর ঘুরছি। টাকা বা পণ্য কোনোটিই দিচ্ছে না ই-অরেঞ্জ। আমার টাকা ওরা যদি না দেয়, আমি সর্বস্বান্ত হয়ে যাব। সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ জানাই ই-অরেঞ্জের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে আমাকে বাঁচান।

আন্দোলনকারী আরও কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ই-অরেঞ্জের কাছে সহস্রাধিক গ্রাহকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা আটকে আছে। তারা দিনের পর দিন গ্রাহকদের ঘুরিয়ে এখন এ অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারা করছে।

গুলশান-১ এর সড়ক অবরোধ শেষে রাতে ই-অরেঞ্জের আন্দোলনরত গ্রাহকরা বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজার বাসায় যান এবং তার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।  

মাশরাফি বলেন, ই-অরেঞ্জের সঙ্গে আমার ছয় মাসের চুক্তি ছিল। সেটা শেষ হয়েছে। আমি এখন এখানে নেই। তবুও একজন গ্রাহক যেহেতু বলেছেন, তার পাশেই আমাকে থাকতে হবে। আইনগত জায়গায় খুব বেশি কিছু তো করার নেই। তবুও সাধারণ মানুষের কারণে কথা বলছি। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তাদের পাশে দাঁড়াব।
 
এর আগে সোমবার বিকেলে গুলশান-১ এর মাঝামাঝি রাস্তায় অবস্থান নেন আন্দোলনরত গ্রাহকরা। এ সময় সড়কে যানচলাচলে বিঘ্ন ঘটে। পরে তারা ই-অরেঞ্জের কার্যালয়ের সামনে চলে যান।

তখন নেহাল নামে এক গ্রাহক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষ গত ১৬ মে থেকে সব ডেলিভারি বন্ধ রেখেছে। ১৮ জুলাই তারা ডেলিভারি তারিখ প্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে লকডাউনের দোহাই দিয়ে ডেলিভারি বন্ধ করে দেয়। পরে জানায় লকডাউন শেষ হলে ডেলিভারি কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে। লকডাউন শেষ হওয়ার আগের দিন ১০ আগস্ট তারা আবার নতুন করে ১৬ আগস্ট (সোমবার) ডেলিভারির তারিখ প্রকাশ করে। কিন্তু নির্ধারিত তারিখেও পণ্যের ডেলিভারি দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

এমএসি/আরএইচ/জেএস