করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে টানা ১৯ দিন ছিল সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ। সংক্রমণের হার সন্তোষজনক পর্যায়ে না এলেও জীবন-জীবিকার তাগিদে বিধিনিষেধ শিথিল করে সরকার। সর্বশেষ টানা আট দিন মৃত্যুর সংখ্যা দুইশর নিচে। টিকা দেওয়ার কার্যক্রমও জোরদার করা হয়েছে। সে কারণে বিধিনিষেধের পথে আর হাঁটতে চায় না সরকার।

সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় গত ১ জুলাই থেকে বিধিনিষেধ কার্যকর করে সরকার। তবে ঈদ উপলক্ষে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই ভোর ৬টা পর্যন্ত বিধিনিষেধে ছিল শিথিলতা। ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত আবারও চলে কঠোর বিধিনিষেধ। এরপর ১১ আগস্ট থেকে পুনরায় বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত আট দিন ধরে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দুইশর নিচে। সর্বশেষ শুক্রবার (২০ আগস্ট) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে মৃত্যু হয় ১৪৫ জনের। এর আগে বৃহস্পতিবার ১৫৯, বুধবার ১৭২, মঙ্গলবার ১৯৮, সোমবার ১৭৪, রোববার ১৮৭, শনিবার ১৭৮ জনের মৃত্যু হয়।

এছাড়া শুক্রবার এক দিনে নতুন করে করোনা শনাক্ত হন ৫ হাজার ৯৯৩ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা ১৪ লাখ ৫৩ হাজার ২০৩ জন।

সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, জুলাই থেকে শুরু হওয়া বিধিনিষেধের কারণে কর্মহীন হয়ে বাসায় বসে থাকতে হয়েছে খেটে খাওয়া অনেক মানুষকে। তাদের বিষয় মাথায় রেখে সরকার বিধিনিষেধ শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বর্তমানে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে। পরিস্থিতি মারাত্মক পর্যায়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলে আর বিধিনিষেধ দেওয়া হবে না।

তারা বলছেন, কোভ্যাক্সসহ বিভিন্ন উৎস থেকে করোনার ২১ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। ইতোমধ্যে দুই কোটিরও বেশি ডোজ দেওয়া হয়েছে। এভাবে টিকা দেওয়া সম্ভব হলে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যাবে। তখন বিধিনিষেধ দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিধিনিষেধ দেওয়ার কারণে খেটে খাওয়া অনেক মানুষকে উপার্জনহীন থাকতে হয়েছে। উপার্জন না করলে তারা খাবে কী? সেজন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশিদিন বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করা কঠিন।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আপাতত এক মাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে বিধিনিষেধ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। সংক্রমণের অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলে পরবর্তীতেও বিধিনিষেধ দেওয়া হবে না। এরমধ্যে টিকা কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত করোনার টিকা এসেছে তিন কোটি নয় লাখ ৪৩ হাজার ৭২০ ডোজ। এর মধ্যে দুই কোটি ২৪ লাখ ১৩ হাজার ৭৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকা নেওয়াদের মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন এক কোটি ৬১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৭৭ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৬২ লাখ ৫৪ হাজার ৪০২ জন।

অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া হয়েছে এক কোটি নয় লাখ ৬২ হাজার ১১৩ ডোজ। এছাড়া সিনোফার্মের ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ৬৫০, মডার্নার ২৭ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৪ এবং ফাইজারের ৯৩ হাজার ১৩৮ ডোজ করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, এ মুহূর্তে সরকারের কাছে ৯৭ লাখ ৮০ হাজার ৮৭৭ ডোজ টিকা মজুত আছে। চলতি মাসের ২২ তারিখের পর চীন থেকে সিনোফার্মের আরও ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসবে। চীনের পাশাপাশি রাশিয়া থেকেও আসবে টিকা। সবমিলিয়ে ২১ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে।

নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এভাবে টিকা দেওয়ার কার্যক্রম চলতে থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যাবে। এছাড়া মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার সবসময় সংক্রমণের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। সামনের দিনগুলোতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে পর্যালোচনা করেই নেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবাই যদি মাস্ক পরে, শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, তাহলে সংক্রমণ এড়িয়ে চলা যাবে। তাই আমাদের এখন স্বাস্থ্যবিধির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।’

এদিকে গত শুক্রবার (১৩ আগস্ট) রাতে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ৪৪তম অনলাইন সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা শেষে সরকারের নেওয়া সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করা হয়।

কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৩ জুলাই থেকে ১০ আগস্টের বিধিনিষেধ কঠোরভাবে পালিত না হলেও জনসমাবেশ হওয়ার মতো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান বন্ধ থাকায় সংক্রমণ হারে উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। তবে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার কোনোটাই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আসেনি।

এতে বলা হয়, এ অবস্থায় সাম্প্রতিককালে সরকারের দ্রুত বিধিনিষেধ শিথিল করার বা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তে সভা উদ্বেগ প্রকাশ করে। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি জীবিকা ও দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা সরকারের দায়িত্ব উপলব্ধি করে ও সরকারের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করে।

‘সভা মনে করে বিধিনিষেধ শিথিলতার ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা তাড়াহুড়ো করছে। ফলে সংক্রমণ আবার বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা বাড়তে পারে, তাতে অর্থনীতি আরও বেশি হুমকির মুখে পড়বে। লকডাউন আরও ১-২ সপ্তাহ চলমান রাখতে পারলে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যেত। এ অবস্থায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সরকারের গৃহীত সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করে।’

কমিটির উদ্বেগ প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা তো (বিধিনিষেধ) বিস্তারিত আলোচনা করেই ওঠানো (শিথিল) হয়েছে। যে মিটিংগুলোতে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, স্বাস্থ্য বিভাগের বেশ কয়েকজন প্রফেসর বা ডিজি উপস্থিত ছিলেন। সব বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।’

এসএইচআর/এসএসএইচ