রোববার (২৯ আগস্ট) ছাদ থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পায় কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা খোরশেদ আলমের চার বছর বয়সী মেয়ে নাজিফা। দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক নিউরো সার্জারি বিভাগে ভর্তির পরামর্শ দেন।

সব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জরুরি ভিত্তিতে নাজিফার অস্ত্রোপচারের কথা জানান ঢামেকের নিউরো সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. পীযূষ কান্তি মিত্র। এ জন্য ১০ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর ৮ হাজার টাকায় অস্ত্রোপচারে রাজি হন তিনি। টাকা পরিশোধের পর রোববার রাত ৩টায় নাজিফার অস্ত্রোপচার করা হয়। যদিও সরকারি হাসপাতালে এ ধরনের অস্ত্রোপচারে কোনো টাকা লাগার কথা নয়।  

শুধু খোরশেদ আলমের মেয়েই নয়, তার মতো প্রতিদিন অসংখ্য রোগীর কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ আছে নিউরো সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. পীযূষ কান্তি মিত্রের বিরুদ্ধে। এছাড়া বিভাগের কর্মচারীদের সঙ্গেও বিভিন্ন সময় নানা বিষয়ে বিরোধে জড়িয়েছেন তিনি। সম্প্রতি বিভাগের কর্মচারীদের ‘দালাল’ বলে আখ্যায়িত করেন তিনি। এর জেরে সোমবার (৩০ আগস্ট) সকালে তাকে ঢাকা মেডিকেলের ৩০৫ নম্বর ওটিতে অবরুদ্ধ করে রাখেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা।

জানতে চাইলে শিশু নাজিফার বাবা খোরশেদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার বাসা কেরানীগঞ্জ। গতকাল (রোববার) আমার মেয়ে ছাদ থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পায়। পরে আমি ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। এরপর সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. পীযূষ কান্তি মিত্র আমাকে জানান অপারেশন করতে ১০ হাজার টাকা লাগবে। আমি বলি গরিব মানুষ, এত টাকা কোথায় পাব? অবশেষে তিনি ৮ হাজার টাকায় রাজি হন। রাত ৩টার দিকে আমার মেয়ের অপারেশন করেন ডা. পীযূষ কান্তি মিত্র। এখন সে অবজারভেশনে আছে। আমি এ বিষয়ে পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেবো।’

ডা. পীযূষ একইভাবে টাকা আদায় করেছেন রোগী গজনবীর (৪০) কাছ থেকেও। তার ভাতিজা জুয়েল বলেন, ‘মাথায় আঘাত পাওয়ায় গতকাল (রোববার) রাতে চকবাজার থেকে আমার চাচাকে ঢামেকের নিউরো সার্জারি বিভাগে ভর্তি করি। রাতে ডা. পিযূষ কান্তি মিত্র জানান আমার চাচার মাথায় অপারেশন করা লাগবে। এ জন্য একটি যন্ত্র কিনতে হবে, যার মূল্য ২০ হাজার টাকা। আমি বললাম, স্যার আমার কাছে তো এত টাকা নেই। পরে আমি তাকে ১০ হাজার টাকা দিই। তারপরও তিনি আমার কাছে আরও ৫ হাজার টাকা দাবি করেন। অবশেষে ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার পর আজ সকালে আমার চাচার মাথায় অপারেশন করেন তিনি। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি এ অপারেশনের জন্য কোনো যন্ত্রই কিনতে হয়নি। যন্ত্র কেনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যন্ত্র কিনেছি।’

জুয়েল আরও বলেন, ‘অপারেশন করার এক পর্যায়ে তিনি আমাকে অপারেশন থিয়েটারে ডেকে নিয়ে জানান, আমার চাচাকে আইসিইউতে নিতে হবে। পরে তিনি আমাকে একটি ফোন নম্বর দিয়ে বলেন অন্য একটি প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউর জন্য যোগাযোগ করতে। আমি ওই নম্বরে যোগাযোগ করি। কিন্তু তাদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আরেকটি হাসপাতালের আইসিইউতে আমার চাচাকে ভর্তি করি। আমি তার কথা মতো ওই প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি না করায় ডা. পীযূষ কান্তি মিত্র আমাকে গালিগালাজ করেন।’

বিষয়টি যাচাই করার জন্য জুয়েলের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে পরিচয় গোপন রেখে পীযূষ কান্তির সুপারিশকৃত ওই হাসপাতালে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। ওই নম্বরে কল দিলে অপর প্রান্ত থেকে মোক্তার হোসেন নামে একজন ফোন রিসিভ করেন। ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদক রোগীর স্বজন সেজে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাকে বলা হয় ডা. পিযূষ কান্তি মিত্র স্যার আপনার নম্বর দিয়েছেন। আমার রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করা লাগবে, এ বিষয়ে কথা বলব। তখন মোক্তার হোসেন বলেন, ঠিক আছে আপনার রোগীর নাম, বয়স ও কোথায় আছেন তা জানান। আমাদের এখানে সিট ফাঁকা আছে। আপনি বললে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেবো। অ্যাম্বুলেন্সে ভাড়া কত জানতে চাইলে মোক্তার জানান ১ হাজার টাকা লাগবে। আপনার হাসপাতালের নাম কী, এটি কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি গ্রিন রোডের ‘ধানমন্ডি ক্লিনিক’।

আরেক ভুক্তভোগী সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, গত ১৯ জুলাই তার মেয়ে সামিয়ার অপারেশনের কথা বলে ৪ হাজার টাকা নিয়েছিলেন ডা. পিযূষ কান্তি মিত্র। এ জন্য তিনি ঢামেক হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

হাসপাতালের বেশ কয়েকজন কর্মচারী ঢাকা পোস্টকে জানান, ডা. পীযূষের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তিনি প্রত্যেক রোগীকে অপারেশন করার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেন। অপারেশন শেষে রোগীদের আইসিইউতে ভর্তির জন্য দালালদের নম্বর দেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। না নিয়ে গেলে রোগীর স্বজনদের গালিগালাজ করেন। তিনি (ডা. পিযূষ কান্তি মিত্র) নিজে এখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিরও অভিযোগ রয়েছে। কু-প্রস্তাব দেওয়ায় গত মাসে হাসপাতালের দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা এক নারী তাকে জুতাপেটা করেন। এ নিয়ে পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই নারী কর্মচারী। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়,  ডা. পীযূষের বিরুদ্ধে জাল মেডিকেল সার্টিফিকেট দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে মামলাও চলছে। জাল সার্টিফিকেটের কারণে অনেকে জেল খেটেছে, অনেকের সংসার ভেঙে গেছে। তার নানা অপকর্মের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১০৫ নম্বর ওটিতে ডিউটিরত কর্মচারীরা বলেন,‘আমরা রোববার রাতে ডিউটি করছিলাম। কোনো কাজ না থাকায় আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তিনি গভীর রাতে এসে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। তিনি বলেন, তোমরা কেন ঘুমাচ্ছ? আমরা জানাই কোনো কাজ নেই কী করব, তাই ঘুমাচ্ছি। তিনি গালি দিয়ে বলেন চতুর্থ শ্রেণির সব কর্মচারী দালাল।

ওই কর্মচারী আরও বলেন, রাত ৩টায় কেন অপারেশন করতে হবে? পরে আমরা জানতে পারি ওই রোগীর বাবার কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা নিয়েছেন ডা. পীযূষ। সকাল ৬টায় আরও একজন রোগীর স্বজনের কাছ থেকে অপারেশনের একটি যন্ত্র কেনার কথা বলে ১৫ হাজার টাকা নেন তিনি। রোগীর স্বজনদের আইসিইউর দালালের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন তিনি। গালিগালাজ করার বিষয়টি আমাদের সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছি। এ ঘটনার জেরে আজ তাকে ২ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

বাংলাদেশ চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতি, ঢামেক হাসপাতাল সাংগঠনিক সংসদের সভাপতি মো. আবু সাইদ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি জানার পর ঢাকা মেডিকেলে আসি। আমাদের অনেকে উপস্থিত থেকে উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনেন। এ সময় ডা. পিযূষ কান্তি রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। রোগীর কাছ থেকে নেওয়া ৮ হাজার টাকা আমাদের কাছে ফেরতও দিয়েছেন তিনি। এছাড়া কর্মচারীদের গালিগালাজ করার বিষয়টিও স্বীকার করেছেন তিনি। আমরা হাসপাতালের পরিচালককে বিষয়টি জানিয়েছি। তিনি বলেছেন, আগামীকাল মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) এ বিষয়ে কথা হবে।’

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে অভিযুক্ত  চিকিৎসক ডা. পীযূষ কান্তি মিত্রর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ফোনে বা সশরীরে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন নম্বরে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

নিউরো সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আজ (সোমবার) সরকারি ছুটি থাকায় আমি মেডিকেলে যাইনি। তবে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি শুনেছি। তিনি রোগীদের কাছ থেকে অপারেশনের জন্য কোনো টাকা নিতে পারেন না। এটি তিনি অন্যায় করেছেন।’

ডা. পিযূষ কান্তির ডিউটির সময় কখন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডিউটির সময় নিয়ে কোনো অসুবিধা নেই। তার তত্ত্বাবধানে যেহেতু রোগী ভর্তি আছে সেহেতু তিনি অপারেশন করতেই পারেন, তবে কোনো টাকা নিতে পারবেন না। আর নারীর অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কোনো তদন্ত কমিটি হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন,‘আমি ফোনে বিষয়টি শুনেছি। আজ যেহেতু সরকারি ছুটি তাই আমি হাসপাতালে যাইনি। আগামীকাল এ বিষয়ে অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরও পড়ুন: ঢামেকে চিকিৎসকের কাণ্ড, স্যান্ডেল খুলে পেটালেন নারী কর্মী

এসএএ/এসকেডি/জেএস