কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের ‘অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য দক্ষতা ত্বরান্বিতকরণ এবং শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পে বেশ কিছু অযৌক্তিক প্রস্তাব ছিল আগে থেকেই। অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন উপকরণসহ নানাবিধ ব্যয় দেখিয়ে মার্চে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। অযৌক্তিক প্রস্তাব থাকলেও প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এর ব্যয় না কমিয়ে উল্টো আট কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে, তবে প্রকল্পের কোনো কোনো খাতে ব্যয় কমানোও হয়েছে। 

মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে প্রকল্পটি। এর বিভিন্ন খাতে অসঙ্গতির বিষয়টি জানা থাকার পরও পরিকল্পনা কমিশনের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। উল্টো তারা প্রকল্পটি একনেক সভায় পাঠাচ্ছে। 

প্রকল্পটির অতিরিক্ত ব্যয় এবং বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে ২৯ মার্চ ‘পাঁচ ফার্নিচারের দাম ৪৩ কোটি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয় ঢাকা পোস্টে।

কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের প্রকল্পটিতে এক হাজার ওষুধ ও প্রতিষেধক কিনতে ২ কোটি টাকার আবদার করা হয়েছে। একজন কর্মকর্তা দেশের বিভিন্ন জেলা ভ্রমণ করে এক কোটি ৩২ লাখ টাকা ভাতা নেবেন বলেও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। প্রকল্প চলাকালীন পাঁচ বছরে ভ্রমণ বাবদ এই অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, অন্যান্য অনেক প্রকল্পের চেয়ে এর ব্যয় সবখাতেই বেশি ধরা হয়েছে। 

কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান সময়ের চাহিদার আলোকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন ও সম্প্রসারণের নতুন কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দক্ষতা উন্নয়ন খাতে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের লক্ষ্যে উচ্চতর বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, লিঙ্গ এবং আয়ের সমতা বিধান ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটি প্রথম প্রস্তাবের সময় এর ব্যয় ছিল ৪ হাজার ২৯২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। কিন্তু পিইসি সভায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৯৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। একনেকে অনুমোদন পেলে প্রকল্পটি চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে বাস্তবায়ন করা হবে। গত ১৮ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ।

ডিপিপি ও একনেক কার্যপত্রের তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে এ প্রকল্পে চার জনকে পুরস্কৃত করতে  ৪ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। পাঁচটি প্যাকেজে ফার্নিচার কিনতে ৪৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এক লাখ ৭ হাজার ৩৮৬ জনকে ফ্যাক্স/ইন্টারনেট/টেলেক্সের (সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদেরকে কোভিড সংক্রান্ত সহায়তা) খরচ ধরা হয়েছে ৯৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।  

প্রকল্পের প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ২৪টি জরিপের জন্য ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা ছিল। কিন্তু পিইসি সভায় জরিপ সংখ্যা বাড়িয়ে ৬১টি করার পাশাপাশি ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৩৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। কনসালটেন্সিতে ১৪৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, গ্যাস ও জ্বালানি খরচ বাবদ ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ৪৫টি প্রশিক্ষণে ৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। এ খাতেও পিইসি সভার পর ব্যয় বেড়েছে ৫ কোটি টাকা। 
৩০ মাস ভেন্যু ভাড়ায় ধরা হয়েছিল দেড় কোটি টাকা, অফিস ভাড়ায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। পিইসি সভার পর এ খাতেও ব্যয় বেড়েছে ১ কোটি টাকার বেশি। অডিও-ভিডিও/চলচ্চিত্র নির্মাণে ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, বিজ্ঞাপনে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পিইসি সভার পর এ খাতেও ব্যয় বেড়েছে ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। 

পিইসি সভার পর ৯০টি সেমিনার/কনফারেন্সের পরিবর্তে ১৮৯টি সেমিনার/কনফারেন্স করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির প্রথম প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ৯০টি সেমিনার/কনফারেন্স বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সেখানে বর্তমানে ১৮৯টি সেমিনার বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এছাড়া ৫টি মোটরযান রক্ষণাবেক্ষণে ৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যদিও প্রথম প্রস্তাবিত ডিপিপিতে মোটরযান খাতে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল।  

এছাড়া আড়াই কোটি টাকা থেকে পিইসি সভায় সম্মানী ভাতা কমে হয়েছে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২২০টি অনুদানে ব্যয় হবে ১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা; যা প্রথম প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ছিল ১ হাজার ২৫ কোটি টাকা, এখাতে পিইসি সভায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে ৬ লাখ ৫১ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ অনুদান দেওয়া হবে ১ হাজার ৮১১ কোটি টাকা; প্রথম প্রস্তাবিত ডিপিপিতে যা ছিল ২ হাজার ১৭ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. জাহাঙ্গীর আলমকে গত দুদিনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ছুটির দিনে কিভাবে কথা বলবো? একনেকের পরে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করলে বিস্তারিত জানতে পারবেন। যে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকে সে প্রকল্প নিয়ে কথা বলার কিছু নেই।’

তিনি বলেন, ‘পিইসি সভার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই প্রকল্পটি একনেক সভায় পাঠানো হচ্ছে। ভ্রমণ ভাতা বা ওষুধ-প্রতিষেধকের বিষয়ে কিছু বলতে হলে ফাইল দেখে বলতে হবে। এছাড়া অনেক সময় পিইসি সভায় প্রস্তাবিত ব্যয়ের চেয়েও ব্যয় বাড়তে পারে। যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যুক্তি দেখাতে পারে সেক্ষেত্রে ব্যয় বাড়তে পারে। যেহেতু আমার কাছে এখন প্রকল্প দলিল নেই, সেহেতু আমি এর বাইরে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারবো না।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদনের ক্ষেত্রে ‘ভ্যালু ফর মানির’ বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে কি না, সেটা দেখা উচিত। মানে যে খাতে যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে, সে ব্যয়ে আসলেই ওই খাতের বাস্তবায়ন টেকসই হবে কি না এটা দেখতে হবে। এটাকেই ‘ভ্যালু ফর মানি’ বলে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা এগুলোর সাথে জড়িত তারা ছালচাতুরির মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে অবাস্তব ব্যয় অনুমোদন করিয়ে নেন। যার মাধ্যমে এভাবে অবৈধ উপায়ে তারা সুবিধা নিয়ে থাকেন। এই প্রবণতা দীর্ঘদিন চলে আসছে। এই প্রকল্পটির ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু যেন না হয়, সেটা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে।’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রকল্পে অতিরিক্ত কোনো কিছু ধরা পড়লে লেখেন। আমার কাছে প্রকল্পটি এখনও আসেনি। আসলে আমি বিষয়টির খোঁজ নেবো। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমরা পরামর্শক নিতে চাই না। যেহেতু প্রকল্পটি ঋণে বাস্তবায়ন হবে, সেহেতু দাতা সংস্থার কিছু শর্ত আমাদের মানতে হয়। তারপরও বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়টি আমি খোঁজ নিচ্ছি।’

এসআর/এনএফ