বাজারে তাজা মাছের পাশাপাশি ব্যাপক চাহিদা রয়েছে শুঁটকি মাছের। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও হাওর-বিল অঞ্চল থেকে সারাদেশে সরবরাহ হয় এই শুঁটকি।

পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমার থেকেও শুঁটকি আমদানি করা হয়। করোনাভাইরাস দেশে আক্রমণ করার আগ পর্যন্তও চাঙ্গাভাবে চলছিল নীরব অবস্থানে থাকা এই ব্যবসায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের আক্রমণে অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো এ খাতেও বিপর্যয় ঘটেছিল।

তবে সবশেষ গত ১০ আগস্ট বিধিনিষেধ শেষ হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে আবারও চাঙ্গা হতে শুরু করেছে করোনায় বিপর্যস্ত হওয়া শুঁটকি মাছের বাজার। জায়গা পরিবর্তন করে কারওয়ান বাজার থেকে তারা এখন বড় পরিসরে এসেছে মোহাম্মদপুরের সাদেক খান কৃষি মার্কেট এলাকায়। 

সোমবার (৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুরের সাদেক খান কৃষি মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে টুকটাক চলছে বেচা-বিক্রি। তবে খুচরার চেয়ে পাইকারি ক্রেতাদের আনাগোনা বেশি। বিক্রেতারা বস্তায়-বস্তায় সাজিয়ে রেখেছেন নানা ধরনের দেশি-বিদেশি শুঁটকি। ক্রেতারা নিজেরাই উল্টে-পাল্টে দেখছেন সেসব। অন্যদিকে মার্কেটের বাইরে পার্কিং লটে কেউবা রোদে শুকাচ্ছেন শুঁটকি।

নদীমাতৃক এ বাংলাদেশে একটা সময় মাছের অভাব ছিল না। মাছ সহজে পচে যায়, তাই এর সংরক্ষণ জরুরি। সেই চিন্তা থেকে প্রাচীনকালে মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হতো। সংরক্ষণ করা এই শুকনো বা শুঁটকি মাছ রাখা যায় কয়েক বছর পর্যন্ত। আর তাই তাজা মাছের পাশাপাশি এই শুঁটকি মাছেরও চাহিদা থাকে বছরজুড়ে।

কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে প্রায় ৫ মাস সময় বন্ধ ছিল এই শুঁটকি উৎপাদন। চাহিদা কম থাকায় সেসময় নষ্টও হয়েছে অনেক শুঁটকি। ব্যবসায়ীদের ভাড়া গুণতে হয়েছে কোল্ড স্টোরেজেরও। ওই সময়টা বাজারে শুঁটকি বিক্রি কমে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৪০ শতাংশে, কমেছিল দামও। তখন ব্যবসায়ীরা বলেছিল, মন্দা কাটতে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত একটি মৌসুম। ওই এক মৌসুম পরে ২০২১ সালে এসে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মন্দা থাকা ব্যবসায় এখন তারা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। বাজার আস্তে আস্তে চাঙ্গা হচ্ছে।

সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ, এই ৫ মাসকে শুঁটকির মৌসুম বলে থাকেন ব্যবসায়ীরা। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎপাদিত শুঁটকি সারাদেশে সরবরাহ হয়। ব্যবসায়ীরা ওই সময় শুঁটকি কিনে কোল্ড স্টোরেজে জমা রাখেন। যা পরবর্তী সময়ে বছরজুড়ে সারাদেশে শুঁটকি মাছের জোগান দেয়।

কারওয়ান বাজারের শুঁটকি ব্যবসায়ী সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার আগে আমার দোকানে দৈনিক বিক্রি হতো দেড় থেকে ২ লাখ টাকা। ২০২০ সালে সেটি সেই বিক্রি নেমে আসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায়। বুঝতেই পারছেন তখন আমাদের অবস্থাটা কী হয়েছিল। বিক্রি ছাড়া কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া গুণতে গুণতেই আমরা প্রায় অস্থির হয়ে পড়েছিল। এখন এই বিধিনিষেধ শেষে আবারও বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। এই দোকানে এখন দিনে বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। বাজার কিছুটা ফিরতে শুরু করেছে।

রাজধানীর ৪ নম্বর শুঁটকি সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি দুলাল মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের লাখ লাখ টাকার ব্যবসায়। কিন্তু গত বছর বিক্রি না থাকায় লসের বড় একটা অংশ গুণতে হয়েছে কোল্ড স্টোরেজের ভাড়ায়। একেক জনের কয়েক টন করে শুঁটকি কোল্ড স্টোরেজে রাখা ছিল। কোল্ড স্টোরেজে ১ টন শুঁটকির দৈনিক ভাড়া প্রায় ১৪০ টাকা, মাসে ৪ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে দিনে ১৫ পয়সা ভাড়া দিতে হয়। এরমধ্যেও অনেক শুঁটকিও আবার নষ্ট হয়। যার ফলে নিয়মিত বিক্রি না হলে বড় একটা অংশ ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের।

৪ নম্বর শুঁটকি সমবায় সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, লকডাউন থাকলে আমাদের ব্যবসা মন্দা যায়, আবার খুলে দিলে একটু ভালো হয়। এভাবেই আমাদের দিন চলছে। মূলত একটা দো-টানার মধ্যে আছি। বলতে গেলে এই করোনাকালীন আমরা যারা শুঁটকি ব্যবসায়ে আছি, তারা সবাই লসে গুনছি। বিক্রির পরেও এক লটের শুঁটকি থেকে যাচ্ছে, কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে, পাওনা টাকা উঠছে না, যারা বাজারে বিক্রি করে তাদের আরও বাকি দিতে হচ্ছে, অনেকের ব্যাংক ঋণ রয়েছে সেটা এখনও শোধ করা সম্ভব হয়নি। এভাবেই চলছে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের জীবন।

গত বছর ৫ মাস শুঁটকি উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এবছর উৎপাদন বন্ধ ছিল না জানিয়ে এ ব্যবসায়ী বলেন, এবছর লকডাউন থাকলেও সবকিছুর চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। যার ফলে শুঁটকি উৎপাদন ও আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটেনি। শুধুমাত্র আমাদের বিক্রি কমে গেছে। আমাদের খুচরা দোকানগুলোতে ২০১৯ সালে ৬০-৭০ হাজার টাকা বিক্রি ছিল প্রতিদিন। ২০২০ সালে সেই বিক্রি কমে দাঁড়ায় ৩০-৪০ হাজারে। লকডাউন খুলে দেওয়ার পরে এখন বিক্রি একটু বেড়েছে। প্রত্যেক দোকানে ৫০-৬০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারছে দোকানিরা। সামনে যদি আবার লকডাউন দেয়, তখন আবার বিপদে পড়ে যাব।

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া ও লন্ডনে শুঁটকি রফতানি হয় বলেও জানান এ ব্যবসায়ী।

বর্তমান বাজারে শুঁটকির দাম
সময় ভেদে শুঁটকির দামের পার্থক্য হয়। আড়ৎদাররা জানিয়েছেন, মৌসুমে দেশের প্রতিটি আড়তে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ ধরনের মাছের শুঁটকি থাকে। তবে মৌসুম শেষে ৩০ থেকে ৪০টি আইটেম সব সময় বাজারে পাওয়া যায়। বর্তমানে বাজারে কেজি হিসেবে মলা মাছের শুঁটকি ৩৬০-৪৫০ টাকা, লইট্টা মাছের শুঁটকি ৪০০-৭০০ টাকা, ছোট-বড় ভেদে চ্যাপা মাছের শুঁটকি ২৫০-৭৫০ টাকা, সাগরের ফ্যাইস্যা মাছের শুঁটকি ৩৫০-৪০০ টাকা, ভোলাই চাটা মাছের শুঁটকি ২০০-২৫০ টাকা, সাগরের চিংড়ি ৪৫০-৫৬০ টাকা, ঘইন্না মাছের শুঁটকি ৬৫০ টাকা এবং নোনা ইলিশ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর শুঁটকি আড়ৎদারদের পরিচ্ছন্ন নতুন আবাস
এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের কারণে ভাঙতে হয়েছে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে থাকা শুঁটকির আড়ৎ। যার ফলে তারা নতুন আবাস গড়েছেন মোহাম্মদপুরের সাদেক খান কৃষি মার্কেটের উল্টো পাশে। কারওয়ান বাজারের ঘিঞ্জি পরিবেশ ছেড়ে তারা এসেছেন উন্মুক্ত পরিবেশে। ৪০ কাঠা জায়গা নিয়ে তৈরি করা নতুন এই মার্কেটে রয়েছে ৫৭টি দোকান, বড় পার্কিং লট, মসজিদ, স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেট, কর্মীদের থাকার জায়গাসহ নানা সুবিধা। পুরো মাকের্ট তৈরিতে আড়াই কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পুরো টাকার যোগান দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা নিজেই।

ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কোথাও এমন পরিচ্ছন্ন শুঁটকির মাকের্ট নেই বলে দাবি সভাপতি নজরুল ইসলামের। তিনি বলেছেন, নতুন জায়গাতে এবছর মার্চ মাসের ১ তারিখে আমরা এসেছি। এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের জন্য আমাদের মার্কেটের এক-তৃতীয়াংশ জায়গা ভাঙ্গা হয়েছে। যার কারণে বাধ্য হয়ে আমরা এখানে এসেছি। এখানে আমরা অনেক সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করেছি। এখন ক্রেতারাও এসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা নিয়ে এই অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ওখান থেকে এখানে আসায় আমাদের তেমন কোনো ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়নি। বরং আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। এত সুন্দর একটা পরিবেশ ক্রেতাদের দিতে পেরে আমাদেরও ভালো লাগছে।

এমএইচএন/এসএম